অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে রহিম উঠে বসল। পানের বাটা থেকে পানি বের করল। সুপুরি কাটুল ফুচি-ফুচি করে। পান মুখে দিয়ে আগের মতো চুপি-চুপি মজিদের জানালায় উঁকি দিল। না এখনো ঘুমায় নি। রহিমা মজিদের কোনো ব্যাপারই বুঝতে পারে না। লেখাপড়া না-জানা মূর্খ বাপ-মার ছেলে যদি বৃত্তিটুত্তি পেয়ে পাস করতে-করতে এম.এ. পাস করে ফেলে তাহলে সে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।
একসময় মজিদের চোখ গিয়ে পড়ে জানালায়। এ কী মা, এখনো ঘুরঘুর করছ? ঘুমাও না কেন?
যাই বাবা যাই।
রহিমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। বারান্দায় এসে বসে রইল একা একা। আধখানা চাঁদ উঠেছে। আলোয় আবছাভাবে সবকিছু নজরে পড়ে। রাতের বেলা একলা লাগে তার। বুকের মধ্যে হু-হু করে। দিনের বেলাটা এতটা খারাপ লাগে না। ঘরের কত কাজকর্ম আছে। কাজের লোক নেই। তাকেই সব করতে হয়। সময়টা বেশ কেটে যায়। বাসার কাছেই মাইকের দোকান আছে একটা। তারা সারাদিনই কোনো গানের সিকিখানা, কোনো গানের আধাআধি বাজায়। বেশ লাগে।
মজিদের বাবারও গান ভালো লাগত। এক-একবার গান শুনে চেঁচিয়ে বলেছে, ফাঁস ক্লাস, ফাঁস ক্লাস। মজিদের বাপ লোকটা আমোদ-আহ্লাদের বড় কাঙাল ছিল। বদনসিব লোক। আমোদ-আহ্লাদ তার ভাগ্যে নাই। কোনোদিন হয়তো জামাটামা পরে খুশি হয়ে গেছে সিনেমা দেখতে। ফিরে এসেছে মুখ কালো করে। হয় টিকিট পায় নি, নয়তো পকেট মার গেছে। কোনো বিয়ের দাওয়াতটাওয়াত পেলে হাসিমুখে গিয়েছে কিন্তু খেতে পায় নি কিছু। তার খাওয়ার আগেই খাবার শেষ হয়ে গেছে। নিজের ছেলেটা যখন লেখাপড়া শেষ করেছে, চাকরিবাকরি করে বাপকে আরাম দেবে, তখনি কথা নেই বার্তা নেই বিছানায় শুয়েই শেষ। রহিমা রান্নাঘর থেকে বলেছে পর্যন্ত— অসময়ে ঘুমাও কেন? চা খাবে, চা দিব?
রহিমা সেই মন্দভাগ্য লোকটার কথা ভেবে নিশ্বাস ফেলল। এমন খারাপ ভাগ্যের লোক আছে দুনিয়ায়ঃ মরণের সময়ও যার পাশে কেউ রইল না। মজিদের তখন কোনো খোঁজ নেই। কোথায় নাকি গিয়েছে মিটিং করতে। তার বাপকে কাফন পরিয়ে খাটিয়ায় তুলে সবাই যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে উঁকি দিয়েছে তখন মজিদ নেমেছে রিকশা থেকে। বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে?
আহা লোকটা সারাজীবন কী কষ্টটা না করল। কী কষ্ট! কী কষ্ট! মেকানিকের আর কয় পয়সা বেতন? বাড়ির জমিজমা যা ছিল বেচে পড়ার খরচ চলল মজিদের। এত কষ্টের পয়সায় পড়ে আজ মজিদের এই হাল। সন্ধ্যা নামতেই বন্ধুরা আসে। মিটিং বসে ঘরে। ট্রেড ইউনিয়ন, মৎস্য সমবায় সমিতি, হেনো তেনো। ছিঃ।
মজিদের মাথায় কিসের পোকা ঢুকেছিল কে জানে। মজিদের বাপকে রহিমা কত বলেছে, ছেলেকে এসব করতে মানা কর গো, কোনোদিন পুলিশে ধরবে তাকে। মজিদের বাপ শুধু বলেছে— বুঝদার বিদ্বান ছেলে, আমি মুর্খ মানুষ, আমি কী বলব?
রহিমার শীত করছিল, সে ঘরের ভেতর চলে গেল। অন্ধকার ঘরে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা লাগল কিসের সঙ্গে। পিতলের বদনা ঝনঝন করে গড়িয়ে গেল কতদূর? মজিদ ঘুম-জড়ানো স্বরে বলল, কে কে?
আমি।
আর কোনো সাড়াশব্দ হল না। রহিমা যখন ভাবছে আবার শুয়ে পড়বে কি না, তখনি শুনল মজিদ বেশ শব্দ করে হাসছে। কী কাণ্ড। রহিমা ডাকল, ও মজিদ মিয়া।
কী?
হাস কেন?
এমনি হাসি। ঘুমাও তো, ফ্যাসফাঁস করে না।
না, মজিদকে রহিমা সত্যি বুঝতে পারে না। শুধু মজিদ নয়, মজিদের বন্ধুদের ও অচেনা লাগে। ঠিক সন্ধ্যাবেলায় তারা আসে। চোখের দৃষ্টি তাদের কেমন-কেমন। কথা বলে থেমে-থেমে, নিচু গলায় হাসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে তাদের আলাপ। সিগারেটের ধোয়ায় ঘর আচ্ছল হয়ে যায়। পাশের রইসুদ্দীনের চায়ের স্টল থেকে দফায়-দফায় চা আসে। কিসের এত গল্প তাদের? রহিমা দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করে।
না ইলেকশন হবে না। পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
কিন্তু না হলে আমাদের করণীয় কী?
শেখ সাহেব কী ভাবছেন তা জানা দরকার।
শেখ সাহেব আপস করবেন। সাফ কথা।
সাদেক বেশি বাড়াবাড়ি করছে। একটু কেয়ারফুল না হলে …
রহিমার কাছে সমস্তই দুর্বোধ্য মনে হয়। তবু রোজ দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে সে শোনে। আর যদি কোনোদিন শিখা নামের মেয়েটি আসে তবে তো কথাই নেই। রহিমা জেঁকের মতো দরজার সঙ্গে সেঁটে থাকে। শিখা আসে লম্বা একটি নকশীদার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে। একটুও সাজগোজ করে না, তবু কী সুন্দর লাগে তাকে। সে হাসতে-হাসতে দরজায় ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে মজিদ গম্ভীর হয়ে বলে, কে কে? (যদিও হাসির শব্দ শুনেই মজিদ বুঝতে পেরেছ কে, তবু তার এই ঢংটা করা চাই-ই।)
আমি, আমি শিখা।
অগ্নিশিখা নাকি?
না, আমি প্রদীপশিখা।
বলতে-বলতে মেয়েটা হাসিতে ভেঙে পড়ে। দরজা খুলে মজিদ বেরিয়ে আসে। মজিদের চোখমুখ তখন অন্যরকম মনে হয়। দেখেশুনে রহিমার ভালো লাগে না। কে জানে শিখাকে হয়তো পছন্দ করে ফেলেছে। হয়তো এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করে রেখেছে অথবা মজিদের বপি সুতাখালীর ঐ শ্যামলা মেয়েটির সঙ্গে মজিদের বিয়ে দেবে বলে কী খুশি (টাঙ্গাইলের লালপাড় একটি শাড়িও সে দিয়েছে হাসিনা নামের ঐ ভালোমানুষ মেয়েটিকে। রহিমা মেয়েটিকে দেখে নি, শুনেছে খুব নরম মেয়ে আর ভীষণ লক্ষ্মী)। আহা মজিদের বাপ বেচারা বিয়েটা দিতে পারল না! আহা!
রহিমা কতবার দেখেছে শিখ এলেই মজিদ কেমন অস্থির হয়ে উঠে। শুধু-শুধু হো হো করে হাসে। চায়ের সঙ্গে খাবার আনতে নিজেই উঠে যায়। কথাবার্তার মঝিখানে ফস করে বলে, আজ আর ইলেকশন-ফিলেকশন ভালো লাগছে না। আজ অন্য আলাপ করব। ঘরে যারা থাকে তারা উসখুস করলেও আপত্তি করে না। শুধু হাসি নয়, গানটানও হয়। শিখা মেয়েটি মাঝে-মাঝে গান গায় তার জন্য সবাইকে খুব সাধ্যসাধনা করতে হয়। খুব অহংকারী মেয়ে)।