প্রথম দিন ভীতমুখে বারান্দায় বসে ছিল। বেগম সাহেব তাকে দেখেও নাদেখার ভান করলেন। দুটা সুন্দর-সুন্দর বাচ্চা রূপা, লোপা; পাশেই খেলছে, অথচ তার দিকে তাকাচ্ছে না। এক সময় সফুরা ভয়েভয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার ভইন?
রূপা তার দিকে না তাকিয়েই বলল, আমাকে ভইন ডাকবে না।
সফুরা চুপ করে গেল। সময় কাটতেই চায় না। এরা তাকে কাজে বহাল করবে কি-না তাও বোঝা যাচ্ছে না। তার খুব পানি পিপাসা হচ্ছে কার কাছে পানি চাইবে?
এক সময় বেগম সাহেব চায়ের কাপ হাতে তার সামনে বসলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী নাম?
সফুরা।
ঘরের কাজকর্ম জানো?
সফুরা কী বলবে বুঝতে পারল না। ঘরের কাজকর্ম সে তো অবশ্যই জানে। ভাত রাঁধা, বাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া …. কিন্তু ঢাকার এইসব বাড়িতে কাজকর্ম কী রকম কে বলবে।
আগে কখনো বাসায় কাজ করেছ?
জে-না। ঢাকায় কী এই প্রথম?
জে।
বেগম সাহেব কঠিন মুখে বললেন, হাত ধরে-ধরে কাজকর্ম শেখাব, তারপর পাখা গজাবে। উড়ে চলে যাবে অন্য বাসায়। তোমাদের আমার চেনা আছে।
আমি কোনোখানে যামু না।
খামোকা এইসব বলবে না। আগে অনেকবার শুনেছি। বেতন চাও কত?
সফুরা চুপ করে রইল। যে তাকে নিয়ে এসেছে সে বারবার বলে দিয়েছে— বেতনের কথা বললে চুপ কইরা থাকবা। আগ বাড়াইয়া কিছু বলবা না। চুপ করে আছে। কিছু বলছে না।
কী, কথা বল না কেন? কত চাও বেতন?
আপনের যা ইচ্ছা।
কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছ?
সফুরা লজ্জা পেয়ে গেল। কাপড়চোপড় আনবে কী? একটা শাড়ি ছিল সেটাই নিয়ে এসেছে। যার কাপড়চোপড় আছে সে কি আর ছেলেপুলে স্বামী ছেড়ে ঢাকায় কাজ করতে আসে?
বেগম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাদের এই আরেক টেকনিক। এক কাপড়ে উপস্থিত হবে। যাতে সুঙ্গে-সঙ্গে একটা শাড়ি কিনে দিতে হয়।
সফুরা মাথা নিচু করে রাখল।
তোমার কী নাম যেন বললে?
সফুরা।
শোন সফুরা, থাক এইখানে। কাজ কর। কয়েকদিন কাজ দেখি। যদি কাজ পছন্দ হয় বেতন ঠিক করব। আমার সংসার ছোট। কাজকর্ম নেই বললেই হয়। মেয়েদের কখনো নাম ধরে ডাকবে না। আন্টি ডাকবে। একজন বড় আন্টি, একজন ছোট আন্টি। মনে থাকবে?
জে।
আমাদের আলাদা বাথরুম। ঐ বাথরুমে কখনো ঢুকবে নামনে থাকবে?
জে।
তোমাকে আলাদা থালা, গ্লাস দেয়া হবে। সব সময় সেগুলি ব্যবহার করবে। আমাদের থালা গ্লাস কখনো ব্যবহার করবে না।
জে আইচ্ছ।
সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। গ্রাম থেকে এসেছ, পেট ভর্তি কৃমি। কৃমির ওষুধ খাইয়ে দেব। মাথায় উকুন আছে?
জে।
উকুনের ওষুধ দেব। লরেকসিন চুলে মেখে গোসল কর।
জে আইচ্ছা।
দুদিন পরপর দেশের বাড়িতে যাওয়া। এর অসুখ তার অসুখ এইসব চলবে। দেশে যাবে বৎসরে একবার। দেশের বাড়ি থেকেও প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে লোক আসবে তাও চলবে না। বেতনের টাকা মাসের দু তারিখে দিয়ে দেব। মনি অর্ডার করে কিংবা কারো হাতে পাঠিয়ে দেবে।
জে আইচ্ছা।
কাচের থালা-বাসন ধরবে খুব সাবধানে। টেবিলের উপর কাচের যে বাটিটা দেখছ, যেখানে ফল রাখা—ঐ বাটিটার দাম তিন হাজার টাকা।
একটা বাটির দাম তিন হাজার টাকা? সফুরার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তিন হাজার টাকায় একটা গরু কেনা যায়। সামান্য একটা বাটি, তার দাম তিন হাজার।
বাটিটা একবার ছুঁয়ে দেখতে হবে।
সফুরা কাজে বহাল হল। যা-কিছু শেখার ছিল, সাতদিনে শিখে গেল। বেগম সাহেব যে তার কাজে খুশি তাও সে নদিনের দিন জেনে গেল। মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে সে শুনল বেগম সাহেব টেলিফোনে কাকে যেন বলছেন, আমার কাজের মেয়েটা চটপটে আছে। কাজ ভালোই করে। শেখার আগ্রহ আছে। তবে টিকবে না। কাজ শেখা হলে অন্য বাড়িতে কাজ খুঁজবে। এদের চেনা অাছে।
বেগম সাহেবের কথা সত্যি হয় নি। সে কোথাও যায় নি। এ বাড়িতে আছে। গত তিন বছরে দেশেও যায় নি। কয়েকবারই যাওয়া ঠিকঠাক হল। তার এমনি কপাল—যখন দেশে যাওয়া ঠিকঠাক হয় তখনি এ বাড়িতে একটা কিছু ঝামেলা লেগে যায়। প্রথমবার হোট আন্টির ফ্লু হল। অসুস্থ মানুষকে রেখে যাওয়া যায় না। পরের বার জাপান থেকে কারা যেন বেড়াতে এল। এ বাড়িতে থাকল এক সপ্তাহ। বাড়িতে মেহমান ফেলে সে যায় কীভাবে? তবে ঐ মেহমানরা যাবার সময় তাকে একটা ঘড়ি দিলেন। কী আশ্চর্য কাণ্ড, তার মতো মানুষকে কেউ ঘড়ি দেয়? ঘড়ি দিয়ে সে কী করবে? ঘড়ির সে কী বুঝে? বকুলের বাবা যখন পরের বার টাকা নিতে এল তখন টাকার সঙ্গে ঘড়িও দিল। মানুষটা অবাক।
ঘড়ি পাইলা কই?
আমারে খুশি হইয়া দিছে।
কও কী তুমি!
যা সত্য তাই কইলাম।
বেজায় দামি জিনিস বইল্যা মনে হয়।
হুঁ। বেইচ্যেন না।
আরে না, বেছ কী! ঘড়ির একটা প্রয়েজন আছে না? ঘড়ির ইজ্জতুই আলাদা।
বকুলের বাবা ঘড়ি হাতে পরে আনন্দে হেসে ফেলল। লোকটা বেজায় শৌখিন। টাকা নিতে যখন আসে মনে হয় ভদ্রলোক। মাথার চুল বেশির ভাগই পেকে গিয়েছিল। একবার এল— সব চুল কুচকুচে কালো। চুলে কলপ দিয়েছে। পাঁচ দশ টাকা নিশ্চয়ই চলে গেছে। লোকটা এইসব দেখবে না। বড় শৌখিন। সফুরা বড় ইচ্ছা করে এই শৌখিন মানুষটাকে চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে চারটা ভাত খাওয়ায়। তিন হাজার টাকা দামের বাটিতে করে সালুন এনে দেয় তা তো সম্ভব না। বেগম সাহেব বলে দিয়েছেন, তোমার স্বামী যে দুদিন পরপর ফুলবাবু সেজে চলে আসে খুব ভালো কথা। আসুক। তাকে ঘরে ঢুকাবে না। বাইরে থেকে বিদায় দেবে। একবার ঘরে ঢুকলে অভ্যাস হয়ে যাবে।