আমি ভাবতে পারি না ভাবী।
নীলু এ কয়দিন কলেজে যায় নি। দিন সাতেক পর যখন প্রথম গেল, ক্লাসের মেয়েরা অবাক হয় বলল, বড় রোগা হয়ে গেছিস তুই। অসুখবিসুখ নাকি?
সে চুপ করে রইল।
কেমন গোলগাল মুখ ছিল তোর, এখন কীরকম লম্বাটে হয়ে গেছে। কিন্তু বেশ লাগছে তোকে ভাই।
ক্লাসে মন টিকল না নীলুর। ইতিহাসের অনিল স্যার ঘুমপড়ানো সুরে যখন গুপ্ত ডায়ানিস্টি পড়াতে লাগলেন তখন ছাত্রীদের স্তম্ভিত করে নীলু উঠে দাঁড়াল।
স্যার আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। বাসায় যাব।
অনিল স্যার অতিরিক্ত রকম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বেশি খারাপ? সঙ্গে কোনো বন্ধুকে নিয়ে যাবে?
না স্যার, একাই যাব।
নীলু ক্লান্ত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে কলেজ গেটের সামনে রঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো মুখ। হাতে একটা কাগজের ঠোঙা।
গত তিনদিন ধরে আমি রোজ একবার করে আসি তোমাদের কলেজে।
নীলু বলল, এই কদিন আসি নি, শরীর ভালো না।
দুজন পাশাপাশি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হটল। তারপর রঞ্জু হঠাৎ দাঁড়িয়ে থেমে বলল, আগস্ট মাসের ৯ তারিখে তোমার বিয়ে?
কে বলল?
কার্ড ছাপিয়েছ তোমরা। রেবার কাছে তোমার বিয়ের কার্ড দেখেছি।
নীলু চুপ করে রইল। রঞ্জু এত বেশি উত্তেজিত ছিল যে, সহজভাবে কোনো কথা বলতে পারছিল না। কোনোমতে বলল, কার্ড দেখেও আমার বিশ্বাস হয় নি। তুমি নিজের মুখে বল।
নীলু মৃদুস্বরে বলল, না সত্যি না। তোমাকেই বিয়ে করব আমি।
কবে?
আজই।
রঞ্জু স্তম্ভিত হয়ে বলল, তোমার মাথা ঠিক নেই নীলু।
মাথা ঠিক আছে। কোর্টে মানুষ কীভাবে বিয়ে করে আমি জানি না।
রঞ্জু বলল, চল আমার মেসে। কী হয়েছে সবকিছু শুনি।
সে নীলুর হাত ধরল।
রঞ্জুর নয়া পল্টনের মেসে নীলু আগে অনেকবার এসেছে। দুপুরের গরমে বসে অনেক সময় গল্প করে কাটিয়েছে কিন্তু আজকের মতো কুলকুল করে ঘামে নি কখনো। রঞ্জু বলল, তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নীলু, বড় ঘামছ।
আমার কিছু হয় নি।
চা খাবে? চা দিতে বলব?
উহুঁ। পানি খাব।
রঞ্জু পানির গ্লাস নিয়ে এসে দেখে নীলু হাত-পা এলিয়ে বসে আছে। চোখ ঈষৎ রক্তাভ। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে সে ভাঙা গলায় বলল,
রেবা তোমাকে আমার বিয়ের কার্ড দেখিয়েছে?
হুঁ।
আর কী বলেছে সে?
বলেছে, তোমাকে নাকি ফরসা মতন রোগা একটি ছেলের সঙ্গে দেখেছে।
নীলু বলল, ওর নাম জমশেদ। ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার।
রঞ্জু কিছু বলল না।
নীলু বলল, ঐ ছেলেটির সঙ্গে আমার বিয়ে হলে তুমি কী করবে?
কী করব মানে?
নীলু ভীষণ অবাক হয়ে বলল, কিছু করবে না তুমি?
তোমার শরীর সত্যি খারাপ নীলু। তুমি বাসায় যাও। বিশ্রাম কর।
নীলু রিকশায় উঠে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আমি তোমার সঙ্গে আসব? বাসায় পৌঁছে দেব?
উহুঁ।
নীলু বাসায় পৌঁছে দেখে অনেক লোকজন। হিরণপুর থেকে খালার এসেছেন। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে তুমুল হইচই। নীলু আলগাভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সন্ধ্যায় চা খেতে বসে সেজো খালার হাসির গল্প শুনে উঁচু গলায় হাসল। কিন্তু রাতের বেলা অন্যরকম হল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নীলু গিয়ে তার দাদার ঘরে ধাক্কা দিল। রেহানা বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে নীলু?
নীলু ধরা গলায় বলল, বড় কষ্ট হচ্ছে ভাবী।
রেহানা নীলুর হাত ধরল। কোমল স্বরে বলল, ডাকব তোমার দাদাকে? কথা বলবে তার সাথে?
ডাকো।
নীলুর দাদা সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে এলেন। অবাক হয়ে বললেন, কী রে নীলু কিছু হয়েছে?
নীলু বলল, কিছু হয় নি দাদা। তুমি ঘুমাও।
তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
রূপা
‘ভাই, আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান?”
আমি ভদ্রলোকের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে– তাও এমন কোন আলাপ না। আমি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি কিনা জানতে চাইলেন। আমি বলাম ‘হ্যাঁ’ এবং ভদ্রতা করে জানতে চাইলাম আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আমার স্ত্রীকে রিসিভ করতে এসেছি। ও চিটাগাং থেকে আসছে। ট্রেন দু’ঘন্টা লেট। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাসায় যাব আবার আসব, ভাবলাম অপেক্ষা করি।
তার সঙ্গে এইটুকু আমার আলাপ। এই আলাপের সুত্র ধরে কেউ যখন বলে, ভাই আপনি কি একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনতে চান, তখন খানিকটা হলেও বিস্মিত হতে হয়। অপরিচিত লোকের কাছ থেকে গল্প শোনার আগ্রহ আমার কম। তাছাড়া আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় লক্ষ করেছি- ইন্টারেস্টিং গল্প বলে যে গল্প শুরু হয়, সে গল্প কখনোই ইন্টারেস্টিং হয় না।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক বুদ্ধিমান হলে আমার চুপ করে থাকার অর্থ বুঝতে পারতেন। বুদ্ধিমান না হলে এই গল্প আমার শুনতেই হবে।
দেখা গেল ভদ্রলোক মোটেই বুদ্ধিমান নন। পকেট থেকে পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে সাজাতে গল্প শুরু করলেন-
“আপনি নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়ে আমার কথা শুনছেন। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ হড়বড় করে গল্প বলা শুরু করেছে। বিরক্ত হবারই কথা। কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন- আজ আমার একটা বিশেষ দিন। এই বিশেষ দিনে আমার মজার গল্পটা কাউকে-না-কাউকে বলতে ইচ্ছে করে। যদি অনুমতি দেন- গল্পটা বলি।”
“বলুন।”
“আপনি কি পান খান?”
“জি-না।”
“একটা খেয়ে দেখুন, মিষ্টি পান। খারাপ লাগবে না।”
“আপনি কি বিশেষ দিনে গল্পের সঙ্গে-সঙ্গে সবাইকে পানও খাওয়ান?”