হাসিনা হতভম্ভ হয়ে বললেন, আজ রাতে?
ইদরিস সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আজ রাতে নয় তো কি পরশু রাতে নাকি? জোবেদ হারামজাদা বড় বিরক্ত করছে। আমি আরো কয়েকদিন দেখেছি।
আজ রাতে যাওয়ার দরকার কী, কাল যাও।
কাল যেতে পারলে আজ যেতে অসুবিধা কী? তোমরা মেয়েমানুষরা যা বোঝ না শুধু সেটা নিয়ে কথা বল। কাপড় গুছিয়ে দিতে বলেছি গুছিয়ে দাও।
বীণার জ্বর।
জ্বরের সঙ্গে কাপড় গোছানোর সম্পর্ক কী? কাপড় তো তুমি গোছাবে। তোমার গায়ে তো জ্বর নেই।
হাসিনা কাপড় গুছিয়ে দিলেন। তাঁর স্বামীকে তিনি চেনেন। কথাবার্তা বলে লাভ হবে না। বীণা একশো দুই পয়েন্ট পাঁচ জ্বর নিয়ে বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে উঠল। বাড়িতে পৌঁছাতে সেই জ্বর বেড়ে গেল একশো চার পয়েন্ট পাঁচ।
ইদরিস সাহেব ছুটি নিয়ে যাননি। বীণাকে রেখে পরদিনই তাঁকে চলে আসতে হলো। বীণা সপ্তাহখানিক জ্বরে ভুগে কংকালের মতো হয়ে গেল। মুখে রুচি নেই। যা খায় তা-ই বমি করে ফেলে দেয়। রাতে ঘুম হয় না। প্রায় রাতই জেগে জেগে কাটিয়ে দেয়। চোখের পাতা এক হলেই ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে।
এই সময় তার ভয়ের অসুখ হয়। সারাক্ষণই ভয় লাগে। কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক ভয়। কেউ হয়তো সামনে দিয়ে গেল অমনি বীণার বুক ধড়াস করে ওঠে। বাতাসে জানালার পাট নড়ে উঠলে বীণার হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করে, সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়। প্রচণ্ড ঘাম হয়।
বীণাদের এই বসতবাড়িটা খুবই পুরনো। বীণার দাদা এক হিন্দু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খুব সস্তায় এই বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাড়ি। পুরো জায়গাটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সংস্কারের অভাবে দেয়াল জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। দোতলার ঘরের বেশির ভাগই ব্যবহারের উপযোগী নয়। একতলার তিনটা ঘর শুধু ব্যবহার হয়। দোতলার ঘর তালাবদ্ধ থাকে।
একটা ঘরে বীণার বাবা এমদাদ সাহেব থাকেন। প্যারালাইসিসের কারণে এই ঘর থেকে বের হবার তাঁর কোনো উপায় নেই। অন্য একটা ঘরে বীণা এবং বীণার দূর-সম্পর্কের মামি মরিয়ম থাকেন। ঘরের কাজকর্ম করার জন্যে বাতাসী নামের কমবয়েসী একটা মেয়ে থাকে। তার চোখের অসুখ আছে। রাতে সে কিছুই দেখে না।
বাড়িতে মানুষ বলতে এই চারটি প্রাণী। সন্ধ্যার পর থেকেই বীণার ভয়-ভয় করে। দোতলার বারান্দায় কিসের যেন শব্দ হয়। মনে হয় খড়ম পরে কেউ যেন হাঁটে। বীণা জানে ইঁদুর শব্দ করছে। তবু তার ভয় কাটে না। দুর্বল নার্ভের কারণেই হয়তো আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে থাকে। সে ফিসফিস করে বলে—কিসের শব্দ মামি?
মামি ঘরের কাজ করতে করতে নির্বিকার গলায় বলেন, জানি না।
মনে হয় ইঁদুরের শব্দ, তা-ই না মামি?
হইতেও পারে। আবার অন্যকিছুও হইতে পারে।
অন্যকিছু কী?
সইন্ধ্যাবেলায় এরার নাম নেওন নাই মা। খারাপ বাতাস হইতে পারে।
খারাপ বাতাস?
কতদিনের পুরনো বাড়ি। উপরের ঘরগুলান খালি পইড়া থাকে। কেউ বাত্তি দেয়া না। ঘরে বাত্তি না দিলে খারাপ বাতাসের আনাগোনা হয়।
বাতি দেন না কেন? বাতি দিলেই তো হয়। কাল থেকে রোজ সন্ধ্যায় বাতি দেবেন মামি।
আচ্ছা দিমুনে। অখন ঘুমাও।
বীণা শুয়ে থাকে। ঘুম আসে না। রাত যতই বাড়তে থাকে দোতলার শব্দ ততই বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় বীণার বাবার গোঙানি। গভীর রাতে তিনি হাঁটুর ব্যথায় গোঙ্গানির মতো শব্দ করেন। সেই শব্দ বীণার কানে অমানুষিক শব্দ বলে মনে হয়। যেন বীণার বাবা নয়, অন্য কেউ শব্দ করছে। সেই অন্য কেউ মানুষগোত্রীয় নয়। একধরনের চাপা হাসিও শোনা যায়।
বীণাদের স্নানঘর মূল ঘর থেকে অনেকটা দূরে। স্নানঘর বীণার খুব প্রিয়। শ্যাওলা-ধরা। দেয়ালঘেরা ছোট্ট চারকোণা একটা জায়গা। ভেতরে চৌবাচ্চা আছে। স্নানঘরের ছাদটা ছিল টিনের। গত আশ্বিন মাসের ঝড়ে টিনের ছাদ উড়ে গেছে। সেই ছাদ আর ঠিক করা হয়নি। গোসলের সময় মাথার উপর থাকে খোলা আকাশ। ঠিক দুপুরবেলায় সূর্যের ছায়া পড়ে চৌবাচ্চার পানিতে। মগ ডােবালেই চৌবাচ্চা থেকে আলো ঠিকরে পড়ে চারদিকের সবুজ দেয়ালে। বীণার বড় ভালো লাগে। দুপুরবেলা বীণার অনেকখানি সময় এই গোসলখানায় কেটে যায়। রোজই মনে হয় গ্রামের বাড়িতে এসে ভালোই হয়েছে। রাতের তীব্র আতঙ্কের কথা তখন আর মনে থাকে না।
এক দুপুরবেলায় এই গোসলখানাতেই অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার ঘটল। বীণা গোসল করছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ঘন নীল আকাশের ছায়া পড়েছে চৌবাচ্চায়। বীণার চমৎকার লাগছে। শরীরটা আগের মতো দুর্বল লাগছে না। সে আপনমনে খানিকক্ষণ গুনগুন করল।
বীণা মাথায় পানি ঢালল। ঠাণ্ডা পানি। শরীর কেঁপে উঠল। আর তখনই সে অদ্ভুত একটা গন্ধ পেল। অদ্ভুত হলেও গন্ধ চেনা, এই গন্ধ সে আগেও পেয়েছে। বীণা আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়ল। নির্জন গোসলখানায় এই গন্ধ এল কোত্থেকে? গুঁড়া কাঠকয়লার সঙ্গে মেশানো নষ্ট দুধের মিশ্র গন্ধ। বীণা মগ ছুড়ে ফেলে গোসলখানার দরজায় আছড়ে পড়ল। দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হবে। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না। এক মুহূর্তও না।
আশ্চর্যের ব্যাপার! বীণা দরজা খুলতে পারল না। ছিটকিনি নামানো হয়েছে। বীণা প্রাণপণে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে অথচ দরজা একচুলও নড়ছে না। যেন কেউ তাকে আটকে ফেলেছে। বীণা চিৎকার করবার চেষ্ট করল, গলা দিয়ে শব্দ বেরুল না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। দরজা তো নড়লই না, কোনো শব্দ পর্যন্ত হলো না। অথচ ঘরে অন্য একরকম শব্দ হচ্ছে। যেন কী-একটা পড়ছে চৌবাচ্চায়। টুপটাপ শব্দ। বৃষ্টির ফোঁটার মতো।