লোকটা তাকে কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। বীণার একবার মনে হলো, লোকটার চোখে হয়তো পাতা নেই। সাপের যেমন চোখের পাতা থাকে না সেরকম। লোকটার সঙ্গে বয়স্ক যে দুজন মানুষ এসেছিলেন তারা অনবরত কথা বলতে লাগলেন। একজন বীণাকে ডাকতে লাগলেন আন্টি। চুল-দাড়ি পাকা বয়স্ক একজন লোক যদি আন্টি ডাকে তখন ভয়ংকর রাগ লাগে। কোনো কথারই জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বীণা অবিশ্যি সব প্রশ্নের জবাব দিল কারণ মামা তার পাশেই বসে আছেন। মামা বসেছেন সোফার ডানদিকে— সে বাঁদিকে।
প্রশ্নের জবাব না দেয়ার কোনো উপায়ই নেই।
তারপর আন্টি, রবি ঠাকুর কত সনে নোবেল পুরস্কার পান তা জানা আছে?
জী না।
উনিশশো তেরো। অবিশ্যি উনি উনিশশো তেরোতে না পেয়ে উনিশশো একত্রিশে পেলেও কিছু যেত আসত না। তবু তারিখটা জানা দরকার। এটা হচ্ছে জেনারেল নলেজ। মেয়েরা শুধু যে রান্নাবান্না করবে তা তো না— তাদের পৃথিবীতে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তাও তো জানতে হবে। কী বলেন আন্টি?
জী।
আন্টি, আপনি খবরের কাগজ পড়েন?
না।
এইটা হচ্ছে মেয়েদের একটা কমন দোষ। কোনো মেয়ে খবরের কাগজ পড়ে না। আপনি কেন খবরের কাগজ পড়েন না, না-পড়ার কারণটা কী আমাদের একটু বলুন তো আন্টি!
বীণা কিছু বলল না। মামা পাশে বসে আছেন এই ভয়েই বলল না। কারণ মামা খবরের কাগজ রাখেন না বলেই সে খবরের কাগজ পড়ে না। এই তথ্যটা এঁদের জানানো নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। মামা রাগ করবেন।
ইদরিস সাহেব বললেন, মা বীণা, ইনাদের চা মিষ্টি দাও।
পাঁচ জাতের মিষ্টি টেবিলে সাজানো। বীণা প্লেটে উঠিয়ে উঠিয়ে সবার দিকে এগিয়ে দিল। লোকটাকে যখন দিতে গেল তখন লোকটা অদ্ভুত একধরনের শব্দ করল। থাবার মতো বিশাল হাত বাড়িয়ে মিষ্টির থালা নিল। বীণা লক্ষ করল লোকটির আঙুলের নখ কালচে ধরনের। নখের মাথা পাখির নখের মতো ছুঁচালো। বীণার গা সত্যি সত্যি কাঁটা দিয়ে উঠল। সে মনে-মনে বলল, আল্লাহ এই লোকটা যেন আমাকে পছন্দ না করে। আল্লাহ এই লোকটা যেন আমাকে পছন্দ না করে।
লোকটা বীণাকে পছন্দ করল কি করল না কিছুই বোঝা গেল না। ইদরিস সাহেব এই প্রসঙ্গে বাসার কারোর সঙ্গেই কোনো আলাপ করলেন না। ইদরিস সাহেবের এই হলো স্বভাব। বাসার কারোর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। নিজে যা ভালো বুঝবেন তা-ই করবেন।
এই যে তিনি আজ বীণার কলেজে যাওয়া বন্ধ করলেন–এর কারণ তিনি কাউকে বলবেন না। ইদরিস সাহেবের জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে নারীজাতির সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ না করা। নারীজাতির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার ফল একটাই–সময় নষ্ট। কী দরকার সময় নষ্ট করার?
ইদরিস সাহেবের বাসায় তিনি ছাড়া সবাই মেয়ে। সব মিলিয়ে সাতজন মেয়ে। ইদরিস সাহেবের স্ত্রী, চার কন্যা, তাঁর এক ছোট বোন এবং কাজের একটি মেয়ে। তাঁর বাসায় দুটি বিড়াল থাকে। এই বিড়াল দুটিও মেয়েবিড়াল। সঙ্গত কারণেই ইদরিস সাহেব বাসায় যতক্ষণ থাকেন মনমরা হয়ে থাকেন। চারদিকে মেয়েজাতি নিয়ে বাস করতে তার ভালো লাগে না। তিনি তাঁর ব্যবসা, তাঁর পরিকল্পনা কিছুই কাউকে বলেন না।
দিন পনেরো বীণার খুব ভয়ে-ভয়ে কাটল। কে জানে হয়তো লোকটা তাকে পছন্দ করে ফেলেছে। তার চেহারা এমন কিছু খারাপ না, পছন্দ করতেও পারে। রং মোটামুটি ফরসা। চোখ দুটো মায়া-মায়া, লম্বা হালকাপাতলা শরীর। সাজলে তাকে ভালোই দেখায়। পছন্দ করে ফেললে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বীণা বেশ কয়েকবার লজ্জার মাথা খেয়ে তার মামিকে জিজ্ঞেস করেছে, মামি, মামা কি কিছু বলেছে?
বীণার মামি হাসিনা পৃথিবীর সরলতম মহিলা। অতি সহজ কথাও তিনি বোঝেন না। একটু ঘুরিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে এমনভাবে তাকান যে মনে হয় অথৈ জলে পড়েছেন। বীণার সহজ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন— কিসের কথা রে?
ঐ যে শুক্রবারে যে আসল?
কে আসল শুক্রবারে?
তিনজন লোক আসল না?
তিনজন লোক আবার কখন আসল?
বিয়ের আলাপ নিয়ে আসল না?
ও আচ্ছা—মনে পড়েছে। না, কিছু বলে নাই। তোর মামা কি কখনো কিছু বলে? হঠাৎ একদিন শুনবি বিয়ের দিন-তারিখ হয়ে গেছে। তোর মামা আগেভাগে কিছু বলবে? কোনোদিন না।
মাসখানিক কেটে যাবার পরেও বীণার ভয় কাটল না। মামা তাকে কোনো কারণে ডাকলেই মনে হতো এই বুঝি বলবেন, বীণা তোর বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেললাম। শ্রাবণ মাসের বার, মঙ্গলবার। তুই তোর বাবাকে চিঠি লিখে দে।
বীণা আতঙ্কে আতঙ্কেই ভয়াবহ কিছু দুঃস্বপ্নও দেখল। এই দুঃস্বপ্নগুলির প্রতিটিতে তার বিয়ে হয় সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে। বাসরঘরে সে আর ছেলেটা থাকে, আর সবাই চলে যায়। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে থাকে। তখন তার স্বামী আদুরে গলায় বলে— লজ্জায় দেখি মরে যাচ্ছ! এই, তাকাও-না আমার দিকে। তাকাও। সে তাকায়। তাকাতেই তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। মানুষ কোথায়, একটা কুকুরের মতো পশু থাবা গেড়ে বসে আছে। হাঁ-করা মুখের ভেতর কুচকুচে কালো একটা জিহ্বা। জিহ্বা মাঝে মাঝে মুখের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। পশুটার নখ ছুঁচালো। তার গা থেকে টক দুধ আর পোড়া কাঠের গন্ধ ভেসে আসছে। স্বপ্নে মানুষ গন্ধ পায় না। কিন্তু বীণা এইজাতীয় স্বপ্নে গন্ধ পেত। তীব্র কটু গন্ধেই একসময় ঘুম ভেঙে যেত।
প্রায় দেড়মাস এরকম আতঙ্কে কাটল। তারপর আতঙ্ক হঠাৎ করেই কেটে গেল। কারণ ইদরিস সাহেব এক ছুটির দিনের দুপুরে ভাত খেতে খেতে বললেন, বিয়েটা ভেঙে দিলাম।