চিত্রা!
হুঁ।
তোমার সুন্দর সংসার হয়েছে এটা দেখেও আমার ভাল লাগছে।
হুঁ।
আমি জানতাম তোমার সুন্দর সংসার হবে।
আপনি মরে গেলেন কেন?
মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয় কি?
এভাবে মরলেন কেন?
যে ভাবেই মরি, মৃত্যু হচ্ছে মৃত্যু।
জ্ঞানের কথা ভাল লাগছে না!
পৃথিবীর সব কথাই জ্ঞানের কথা।
আপনি মরে গেলেন কেন?
কেউ একজন ভেবেছিল আমার মৃত্যুতে তোমার সমস্যা সমাধান হবে। হয়েছেও তাই। তোমার এখন আর কোন সমস্যা নেই।
আপনাকে কি কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল?
হুঁ।
আমার তাই মনে হয়েছে। আপনার ডেড বডি উঠোনে পড়েছিল— আমি দেখতে যাই নি।
ভাল করেছ। দৃশ্যটা অসুন্দর। অসুন্দর কিছু না দেখাই ভাল।
কে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল?
যেই ফেলুক। তার উপর আমার কোন রাগ নেই?
আমারো নেই। তারপরেও জানতে ইচ্ছে করে কে। আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তখন সব সময় মনে হত আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা বলুনতো আমি কি ফেলেছি?
না–তোমার মা ফেলেছিলেন।
ও আচ্ছা।
তোমার মার উপর আমার কোন রাগ নেই চিত্রা।
আমিতো আপনাকে আগেই বলেছি আমারো রাগ নেই।
তোমার মেয়েটি খুব সুন্দর হয়েছে ওর নাম কি?
ওর নাম রেনু – ভাল নাম রেহনুমা।
সুন্দর নাম।
ওর খুব বুদ্ধি।
শুনে ভাল লাগছে চিত্রা।
কতদিন পর কথা বলছেন আমার অসম্ভব ভাল লাগছে।
তোমার ভাল লাগছে শুনে আমারো ভাল লাগছে। আমি সারারাত কথা বলব তোমাকে কিন্তু তারপর ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে।
আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আপনি যদি আমাদের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে বলেন আমি লাফিয়ে পড়ব। আপনি বলে দেখুন।
তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না।
কি করতে হবে বলুন।
ভোরবেলা তুমি ছাদে উঠবে, পারবে না?
পারব।
হাতে থাকবে পাথরটা।
আচ্ছা।
তারপর পাথরটা ছুড়ে ফেলবে ঠিক আমি যে জায়গায় পড়েছিলাম সেই জায়গায়।
কেন?
আমি পাথরের ভেতর বন্দি হয়ে আছি। পাথরটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেলেই আমি মুক্তি পাব।
আমার এখন জ্ঞানের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে, আপনি জ্ঞানের কথা বলুন।
I often see flowers from a passing car
That are gone before I can tell what they are.
এর মানে কি?
রবার্ট ফ্রস্টের একটা বিখ্যাত কবিতার প্রথম দুটি লাইন।
জ্ঞানের কথা শুনতে ভাল লাগছে না, অন্য কিছু বলুন ….. ভালবাসার কথা বলুন! আচ্ছা ভালবাসা কি?
রাত শেষ হয়ে আসছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চিত্রা পাথর হাতে খুব সাবধানে খাট থেকে নামল।
সুরমা ফজরের নামাজে বসেছিলেন। বিকট শব্দে তিনি নামাজ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। ভারী কিছু যেন ছাদ থেকে পড়ল।
কে পড়ল? তার বুধ ধ্বক ধ্বক করছে। সেই ধ্বক ধ্বকানি তীব্র হবার আগেই চিত্রা ঢুকল। সুরমা স্বাভাবিক হলেন। সহজ গলায় বললেন, কিসের শব্দ?
চিত্রা খুব সহজ গলায় বলল, আমার যে একটা পাথর ছিল সেই পাথরটা টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গলাম। ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলেছি— এক্কেবারে শত খও হয়েছে।
সুরমা তাকিয়ে রইলেন।
চিত্রা বলল, চা খাবে মা? চা বানিয়ে নিয়ে আসি তারপর এসো দুজনে মিলে চুকচুক করে চা খাই। ও আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি–তুমি জোবেদ চাচাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলে তাই না মা?
সুরমা তাকিয়েই রইলেন কোন জবাব দিলেন না। চিত্রা হালকা গলায় বলল, ভালই করেছ মা। তোমার চায়ে চিনি দেব? তুমি চায়ে চিনি খাওতো?
বীণার অসুখ
বীণার বয়স একুশ।
সে লালমাটিয়া কলেজে বি.এ. সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ত। বীণার মামা ইদরিস সাহেব একদিন হঠাৎ বললেন, বীণা তোর কলেজে যাবার দরকার নেই। বাসায় থেকে পড়াশোনা কর। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই হবে। কলেজে আজকাল কী পড়াশোনা হয় তা তো জানাই আছে। যাওয়া নাযাওয়া একই।
বীণা ঘাড় নেড়ে ক্ষীণস্বরে বলল, জী আচ্ছা।
মামার কথার ওপর কথা বলার সাহস বীণার নেই। তার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ মামা দেন। গত বছর গলার একটা চেন বানিয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে যদি ঠিক হয় সেই খরচও মামাকেই দিতে হবে। বীণার বাবা প্যারালাইসিস হয়ে দেশের বাড়িতে পড়ে আছেন। তাঁর পক্ষে একটা টাকাও খরচ করা সম্ভব না। তিনি সবার কাছ থেকে টাকা নেন। কাউকে কিছু দেননি।
ইদরিস সাহেব বললেন, বীণা তুই আমাকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দে। আর শোন, কলেজে না যাওয়া নিয়ে মন-টন খারাপ করিস না। মনখারাপের কিছু নেই।
জী আচ্ছা মামা।
বীণা শরবত আনতে চলে গেল। তার মনটা অসম্ভব খারাপ। কলেজ বন্ধ করে দেবার কোনো কারণ সে বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই। দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকেই-বা সে কী করবে? শরবত বানাতে বানাতে তার মনে হল— হয়তো তার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। গফরগাঁয়ের ঐ ছেলে শেষ পর্যন্ত হয়তো রাজি হয়েছে। ওরাই হয়তো বলেছে— মেয়েকে কলেজে পাঠাবেন না। বিয়ে ঠিকঠাক হলে ছেলেপক্ষের লোকজন অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত দিয়ে দেয়।
গফরগাঁয়ের ঐ ছেলেটাকে একেবারেই পছন্দ হয়নি। কেমন যেন পশুপশু চেহারা। সোফায় বসেছিল দুই হাঁটুতে দুহাত রেখে। মুখ একটু হাঁ হয়েছিল। সেই হাঁ-করা মুখের ভেতর কালো কুচকুচে জিভ। বীণার দিকে এক পলক তাকাতেই বীণার বুক ধক করে উঠল। মনে হলো একটা পশু জিভ বের করে বসে আছে। তার নাকে ঝাঁঝালো গন্ধও এসে লাগল। গন্ধ ঐ লোকটার থেকে আসছিল। টক দুধ এবং পোড়া কাঠের গন্ধ একত্রে মেশালে যেরকম গন্ধ হয় সেরকম একটা গন্ধ। গা কেমন ঝিমঝিম করে।