বাবা এত আগ্রহ করে তোমাকে নিতে চাচ্ছে তাঁর কত রকম প্লান।
যথেষ্ট বক বক করেছিস। আর না। তোকে ফেলে রেখে আমি যাব না। এটা আমার ফাইন্যাল কথা।
মার বাড়িতে এসে চিত্রার খুব ভাল লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কিছু কিছু জিনিস বদলায় না। সেই কিছু কিছু জিনিসের একটি হচ্ছে মার বাড়ি। মা বদলে গেছেন। একটা চোখে কিছুই দেখেন না। হাত কঁপা রোগ হয়েছে— পারকিনসনস ডিজিজ। সারাক্ষণই হাত কাঁপে। কিন্তু মনের দিক থেকে আগের মতই আছেন। খানিকটা পরিবর্তন অবশ্যি হয়েছে–আগে বোকার অব ধরে থাকতেন এখন থাকেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর বোকা ভাব ধরে থাকার প্রয়েজন সম্ভবত ফুরিয়েছে। ভাড়াটে, স্বামীর ব্যবসা, দোকান সব তিনি নিজে চালান এবং ভালই চালান। আজীজ সাহেব তার বোকা স্ত্রীর কর্মক্ষমতা দেখে যেতে পারেনি। দেখে গেলে বিষ্মিত হতেন।
চিত্রা বেশির ভাগ সময় তার মায়ের সঙ্গে গল্প করে কাটায়। তার সব গল্পই স্বামী এবং কন্যাকে কেন্দ্র করে।
রুনির খুব বুদ্ধি হয়েছে মা। ওর বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে ভয় লাগে।
বুদ্ধিতে ভাল জিনিস! বুদ্ধি দেখলে ভয় লাগবে কেন?
অতিরিক্ত বুদ্ধির মানুষ অসুখী হয় এই জন্যেই ভয়। যার মোটামুটি বুদ্ধি সে থাকে সুখে। এই যে আমাকে দেখ আমি সুখে আছি।
সুখে আছিস?
খুব সুখে আছি। স্বামীর ভালবাসা পুরোপুরি পেয়েছিস?
হুঁ। ও আমাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না। একদিন কি হয়েছে মা শোন, ওর স্কুল জীবনের এক বন্ধুর ছেলের জন্মদিনে গিয়েছে। আমারো যাবার কথা—ভাইরাস জ্বরে ধরেছে বলে যাইনি। ও একা গিয়েছে। রাত আটটায় তার টেলিফোন। টেলিফোনে বলল, চিত্রা আমার বন্ধু খুব ধরেছে বাসায় খেয়ে আসতে। খেয়ে আসব? আমি বললাম, এ কি রকম কথা? বন্ধু খেতে বলেছে খেয়ে আসিবে এর মধ্যে জিজ্ঞেস করা করির কি আছে। অবশ্যিই খেয়ে আসবে। টেলিফোনটা যে করেছে তারো ইতিহাস আছে। বন্ধুর বাসায় টেলিফোন নেই, কাৰ্ডফোন থেকে করেছে।
সুরমা হাসি মুখে বললেন, গৃহপালিত স্বামী।
চিত্রা আনন্দিত গলায় বলল, আমার গৃহপালিত স্বামীই ভাল।
পোষ মানাতে পারলে সব স্বামীই গৃহপালিত হয়। তুই পোষ মানানোর কায়দা জানিস। আমি জানতাম না।
তুমিও জানতে। তুমি সেই কায়দা ব্যবহার করনি। বোকা টাইপের স্ত্রীর স্বামীকে গৃহপালিত করে ফেলতে চায়–যাদের খুব বেশি বুদ্ধি তারা চায় না। ঠিক বলিনি মা?
মনে হয় ঠিকই বলেছিস।
ও দশদিনের জন্যে ভিয়েনা গিয়েছে। কিন্তু মা আমি নিশ্চিত ও চারদিনের মাথায় ফিরে আসবে। এই নিয়ে আমি এক লক্ষ টাকা বাজি ধরতে পারি। বাজি ধরবে?
পাগল হয়েছিস বাজি ধরলেই আমি হারব।
মনের আনন্দে চিত্রা হাসতে লাগল। সেই হাসি দেখে সুরমার মন ভরে গেল। তিনিও অনেকদিন পর মন খুলে হাসলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এমন আনন্দময় সময় তাঁর জীবনে আসেনি।
রাতে শোবার সময় রুনি রহস্যময় গলায় বলল, মা দেখ কি পেয়েছি। এই তাকাও একটু।
কি পেয়েছিস?
একটা পাথর। এই দেখ মা— পাথরটার গাটা কি স্মুথ।
চিত্রা তাকাল। তার শরীর মনে হল জমে গেছে। শরীরের ভেতরটা জমে গেলেও হাত পা কাঁপছে। রুনি বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে মা?
চিত্রা জড়ানো গলায় বলল, পাথর কোথায় পেয়েছিস?
খাটের নিচে। তুমি এ রকম করছ কেন?
চিত্রার মাথা যেন কেমন করছে। সে এসে খাটে বসল।
রুনি বলল, পানি খাবে মা? পানি এনে দেব?
হুঁ।
রুনি পানির গ্লাস হাতে এসে দেখে তার মা পাথর কোলে নিয়ে বসে আছে। মার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখ রক্তশূন্য। যেন অনেকদিন কঠিন রোগ ভোগ করে উঠেছে।
মা পানি নাও।
চিত্রা আগের মতই জড়ানো গলায় বলল, পানিটা খাইয়ে দাও মা। কথা অস্পষ্ট শুনাল আবার তার পুরানো অসুখটা কি ফিরে আসছে?
পাথরটা কোলে নিয়ে বসে আছ কেন মা?
ছোটবেলায় আমি এই পাথর নিয়ে খেলতাম।
এতবড় পাথর নিয়ে কি খেলতে?
পাথরটাকে গোসল করাতাম। আদর করতাম। ঘুমুর্বার সময় সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতাম। চুমু খেতাম।
কেন?
তখন আমার একটা অসুখ হয়েছিল।
অসুখটা কি এখনো আছে?
না।
ঘুমুবে না মা?
হ্যাঁ ঘুমাব।
চিত্রা পাথর সঙ্গে নিয়ে ঘুমুতে গেল। রুনি দেখল কিন্তু কিছুই বলল না। মাকে তার এখন খুবই অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে মা অপরিচিত একটা মেয়ে যাকে সে চিনতে পারছে না, মাও তাকে চিনছে না। রুনি ভয়ে ভয়ে ডাকল, মা মা।
চিত্রা মেয়ের দিক থেকে মুখ সরিয়ে অন্য পাশে ফিরল। তার হাতে পাথরটা ধরা। রুনি আবার ডাকল, মা মা, একটু এদিকে ফের।
চিত্রা ফিরল না বা জবাবও দিল না। রাত বাড়তে লাগল। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও চিত্রা ঘুমুতে পারছে না। ঘুম না হবার জন্যে তার কষ্ট হচ্ছে না। ঘর অন্ধকার। পাশেই তার মেয়ে ঘুমুচ্ছে। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বারান্দার বাতির খানিকটা আলো এসে পড়েছে বিছানায়। চিত্রা ঘুমুচ্ছে তার পরিচিত খাটে। এই ঘরের প্রতিটি জিনিস তার চেন তারপরও সব কেমন অচেনা হয়ে গেছে। মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে। মনে হচ্ছে সে একগাদা ঘুমের অমুধ খেয়েছে।
চিত্রা।
চিত্রা বলল, হুঁ।
তুমি কেমন আছ?
ভাল।
পাশে যে ঘুমচ্ছে সে কি তোমার মেয়ে?
হুঁ।
কেউ একজন তাকে প্রশ্ন করছে। সেই কেউটা কে? পাথরটা কি প্রশ্ন করছে? হ্যাঁ তাইতো পাথরটাতো কথা বলছে। চিত্রা বিষ্মিত হল না। পাথরটা তার সঙ্গে কথা বলছে এটা তার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সে জবাব দিচ্ছে এটাও স্বাভাবিক। কেন সে জবাব দেবে না?