চিত্রার ঘরের বাতি জ্বলছে। বাতি জ্বেলে সে কি করছে? দরজায় টোকা দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন? চিত্রা রেগে যাবেনাতো? সে আজকাল অল্পতেই রেগে অাগুন হচ্ছে। অকারণেই রাগছে। তিনি মেয়ের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। টোকার শব্দ শুনেই চিত্রা বলল, কি চাও মা?
ঘুমাচ্ছিস না?
না।
না কেন? ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে কাজেই আমিও জেগে আছি। গল্প করছি।
কার সঙ্গে গল্প করছিস?
পাথরটার সঙ্গে।
মা দরজাটা একটু খুলতে।
সুরমা ভেবেছিলেন মেয়ে দরজা খুলবে না। রাগ করবে। সে রকম হল না। চিত্রা দরজা খুলল। তার এক হাতে পাথর। মেয়ে কি সারাক্ষণই পাথর হাতে বসে থাকে। সুরমা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তুই পাথরের সঙ্গে গল্প করছিলি?
হুঁ।
পাথর কখা বলতে পারে?
পাথর কি কথা বলবে? পাথর কি মানুষ না-কি? আমি কথা বলি ও শুনে।
তুই ঘুমুতে যাস কখন?
আমি ঘুমুতে যাই না। রাতে আমার ঘুম হয় না মা। আগে ঘুমের অষুধ খেলে ঘুম হত এখন তাও হয় না। আজ পাঁচটা ঘুমের অষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম। ঠিক এক ঘন্টা পর জেগে উঠেছি।
তুই একজন ভাল ডাক্তার দেখা।
শুধু শুধু ডাক্তার দেখাব কেন? আমার জ্বর হয়নি। মাথা ব্যথা হচ্ছে না। দিব্যি আরামে আছি। মা তুমি এখন যাও তার সঙ্গে আমার খুব গোপন কিছু কথা আছে। তোমারে সামনে বলা যাবে না।
তুই শুয়ে থাক আমি তোর চুলে বিলি দিয়ে দি।
তুমি আমাকে অনেক বিরক্ত করেছ। এখন যাও আর না।
তিনি বের হয়ে এসে জায়নামাজে বসলেন। ফজর ওয়াক্ত পর্যন্ত দোরুদ পাঠ করলেন। দরুদে শেফা।
ফজরের নামাজ শেষ করেই তিনি খতমে ইউনুস শুরু করলেন। এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার পড়তে হবে দোয়া ইউনুস। ইউনুস নবী এই দোয়া পড়ে মাছের পেট থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। সুরমা যে বিপদে পড়েছেন—মাছের পেটে বাস করা তার কাছে কিছুই না। কিছু কিছু বিপদ থাকে মাকড়সার জালের মত সূক্ষ্মচোখে পর্যন্ত দেখা যায় না, কিন্তু মাকড়শার জালের মত হালকা না। এই ধরনের বিপদ আপদ থেকে সচরাচর উদ্ধার পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র আল্লাহ পাকের অসীম দয়াতেই উদ্ধার সম্ভব। তিনিতো কোন পাপ করেন নি। আল্লাহ পাক কি তাকে দয়? করবেন না?
আল্লাহ পাক সুরমাকে দয়া করলেন—এক রোববার ভোরে আজীজ সাহেবের বাড়ির উঠান লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। উঠানে জোবেদ আলি হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন—তাঁর মাথা থ্যাতলানো। ঘিলু বের হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষটা খুব ভোরবেলা তিনতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গেছে?
আজীজ সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর লাভের গুড় পিপড়া খেয়ে ফেলল। ঘটনা সামলাবার জন্যে পুলিশকে ষাট হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। পুলিশ ইচ্ছা করলে কৃষ্ণপক্ষের রাতকে চৈত্রমাসের দিন করে ফেলতে পারে। সামান্য আত্মহতাকে মার্ডার বলতে তাদের আটকাবে না। সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাকে জেল হাজতে পঁচতে হবে।
পুলিশের সমস্যা সামাল দিলেও আজীজ সাহেব ঘরের সমস্যা সামাল দিতে পারলেন না। চিত্রার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল। তার কথা অস্পষ্ট হয়ে গেল। কাকে কি বলে না বলে কিছু বোঝা যায় না। তার খাওয়ার ঠিক নেই, নাওয়ার ঠিক নেই। সারাদিন তার কোলে থাকে পাথর। সে নিজে গোসল করে না, পাথরটাকে রোজ গোসল দেয়। গুণগুণ করে পাথরকে কি যেন বলে।
আজীজ সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, এর কি হয়েছে? এ রকম করে কেন?
সুরমা বললেন, কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে মাথাতো খানিকটা এলোমেলো হবেই।
কারো মাথা এলোমেলো হল না, তারটা হল কেন?
বাচ্চা মানুষ। ঠিক হয়ে যাবে।
পাথর নিয়ে এইসব কি করছে?
বললামতো ঠিক হয়ে যাবে কয়েকটা দিন যাক।
ব্যাপারটা কি ঠিকমত গুছিয়ে বলতো।
ব্যাপার কিছু না, জোবেদ ভাই চিত্রাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সারাক্ষণ মা মা ডাকতেন। চিত্রা দেখতেও তাঁর মেয়ের মত। নিজের মেয়েকে দেখেন না সেই জন্যে —–।
তিনি চিত্রাকে স্নেহ করতেন বলে চিত্রাকে একটা পাথর গালে লাগিয়ে বসে থাকতে হবে? আমিতো কিছু বুঝছি না–ঐ হারামজাদার সঙ্গে আমার মেয়ের কি হয়েছে?
তুমি মাথা গরম করো না। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার।
চিকিৎসা করাব, কয়েকটা দিন যাক।
চিত্রার অসুখ সারতে দীর্ঘদিন লাগল।
এক সকালে সে তার স্যুটকেসে পাথর ভরে রেখে সহজ গলায় মাকে ৰূলল, মা নাশতা দাও ক্ষিধে লেগেছে।
সুরমা মনের আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তার দুবছর পর চিত্রার বিয়ে হয়ে গেল এক ডাক্তার ছেলের সঙ্গে। শ্যামলা হলেও ছেলেটি সুপুরুষ। খুব হাসি খুশি, সারাক্ষণ মজা করছে। চিত্রার তার স্বামীকে খুব পছন্দ হল। পছন্দ হবার মতই ছেলে। চিত্রা মণিপুরী পাড়ায় তার স্বামীর পৈত্রিক বাড়িতে বাস করতে গেল। তার জীবন শুভ খাদে বইতে শুরু করল।
তের বছর পরের কথা।
চিত্র তার মেয়েকে নিয়ে কিছুদিন বাবার বাড়িতে থাকতে এসেছে। চিত্রার স্বামী গিয়েছে ভিয়েনায় ডাক্তারদের কি একটা সম্মেলনে। চিত্রারও যাবার কথা ছিল, টিকিট ভিসা সব হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা ফ্লাইট, ভোরবেলা ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটল। চিত্রার মেয়ে রুনি সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে সামনের একটা পঁাত ভেঙ্গে ফেলল। এমন কোন বড় দুর্ঘটনা না। কিছু রক্ত পড়েছে, ঠোট কার্টার জন্যে ফুলে গেছে। এতেই চিত্রা অস্থির হয়ে গেল। সে কিছুতেই মেয়েকে ফেলে যাবে না। সে থেকে যাবে। রুনি যতবারই বলে, তুমি যাওতো মা ঘুরে আস। তুমি না গেলে বাবা মনে খুব কষ্ট পাবে। ততবারই চিত্রা বলে, তুই মাতব্বরি করবি নাতো। তোর মাতাব্বরি অসহা লাগে।