তুই সত্যি সত্যি পাথর নিয়ে ঘুমুবি?
হুঁ।
পাথরটা তোকে কে দিয়েছে জোবেদ সাহেব?
ইয়েস মাদার।
তিনি তোকে খুব স্নেহ করেন?
সেই করেন না হাতী। স্নেহ করলে কেউ কাউকে পাথর দেয়? দামী গিফট টিফট দিতে পারে। আড়ং এর সেলোয়ার বা পাথর বসানো নেকলেস।
পাথরটা দিলেন কেন?
উফ মা চুপ করতো। তোমার বকবকানীর কারণে পাথর বেচারা ঘুমুতে পারছে না। ও ডিস্টারবেন্স এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না। এই শেষবারের মত আমি তোমাকে আমার ঘরে ঘুমুতে দিলাম আর না।
চিত্রা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার একটা হাত পাথরের উপর রাখা। সুরমা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন ঘুমের মধ্যেই চিত্রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। পাথরটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে নিল। একি সর্বনাশ! সুরমা সারা রাত জেগে রইলেন।
৩.
জোবেদ আলি বললেন, তোমার কি খবর?
চিত্র হাসিমুখে বলল, আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি।
খুব ভাল কথা বিরক্ত কর।
জ্ঞানের কিছু কথা জানিয়ে দিনতো।
জ্ঞানের কথা জানতে চাও?
হু চাই। জ্ঞানের কথা বলতে বলতে আপনি যখন ক্লান্ত হয়ে যাবেন তখন কিছুক্ষণ ভালবাসার কথা বলতে পারেন।
ভালবাসার কথাও শুনতে চাও?
হুঁ চাই। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব অসভ্য মেয়ে ভাবছেন। ভাবলে ভাববেন। আমি কেয়ার করি না।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তাই। এখন থেকে আমি ঠিক করেছি যখনই আমার জ্ঞানের কথা শুনতে ইচ্ছা করবে তখনি আমি চলে আসব। সেটা সকাল হতে পারে, দুপুর হতে পারে আবার রাত তিনটাও হতে পারে। কাজেই কখনো যদি রাত তিনটায় আপনার দরজায় টুক টুক শব্দ হয় তাহলে ভূতটুত ভেবে বসবেন না। এখন বলুন আপনার জ্ঞানের কথা।
জ্ঞানের কথা শুনবে?
হুঁ।
ফেরাউনদের সময়কার হিরেললাগ্রাফি দিয়ে একটা গল্প বলব?
বলুন।
কাগজ কলম দাও গল্প বলি।
গল্প বলতে কাগজ কলম লাগে?
এই গল্পে লাগে। গল্পটা হচ্ছে আদি ও মৌলিক গল্প। গল্পের মজাটা হল চিত্র লিপিতে, গল্প শোনার সঙ্গে সঙ্গে কি ছবি আঁকা হচ্ছে তা খেয়াল রাখবে।
এক দেশে এক রাজা ছিল।
রাজার এক রাণী ছিল।
রাজ্জা ও রাণী সুখে বাস করত
এক সময় রাণী গর্ভবতী হলেন
তখন হঠাৎ রাজা মারা গেলেন
যথাসময়ে রাণীর এক সন্তান হল
এক সময় রাণীও মারা গেলেন
বেঁচে রইল শুধু রাজকুমার।
এবং রাজকুমারের মধ্যে রাজবংশের ভবিষ্যৎ বীজ।
চিত্রকথায় পুরো গল্পটা হবে
গল্পটা কেমন লাগল?
চিত্র। ক্ষীণ গলায় বলল, অদ্ভুত। জোবেদ আলি বললেন, ছবি এঁকে একে বান্ধবীদের সঙ্গে এই গল্পটা করবে দেখবে ওরা খুব মজা পাবে।
চিত্রা গম্ভীর মুখে বলল, আমার কোন বান্ধবী নেই। বান্ধবী থাকলে অবশ্যই এই গল্পটা বলতাম। আচ্ছা আপনি কি হাত দেখতে পারেন?
না।
আমার মনে হচ্ছে পারেন। প্লীজ আমার হাত দেখে দিন।
এস্ট্রলজির দুএকটা বই টই পড়েছি–কিন্তু হাত দেখার উপর কোন বই পড়ি নি।
চিত্রা বলল, আমি হাত দেখার উপর কোন বই পড়ি নি-কিন্তু আমি হাত দেখতে জানি। একজনের কাছ থেকে শিখেছি–দেখি আপনার হাতটা দিন-আমি দেখে দেই।
এই বয়সে তুমি আমার হাতে কিছু পাবে না। মৃত্যু রেখা পেতে পার। মৃত্যু রেখার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই।
আপনার না থাকলেও আমার আছে।
জোবেদ আলি গম্ভীর গলায় বললেন–হাত দেখা টেখা কিছু না, তুমি আসলে আমার হাত ধরার একটা অজুহাত খুঁজছ।
আপনার তো বেশী বুদ্ধি এইজন্যে সব আগে ভাগে বুঝে ফেলেন। আপনার হাত ধরতে চাইলে আমি সরাসরিই হাত ধরতাম, ভনিতা করতাম না।
হাত ধরতে চাও না?
চিত্রা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গঢ়ি গলায় বলল, চাই।
জোবেদ আলি হাত বাড়িয়ে দিলেন।
সুরমা ছাদে এসেছিলেন শুকনা কাপড় নিতে। শুকনা কাপড় নেয়াটা তাঁর অজুহাত তিনি আসলে এসেছেন চিত্র কি করছে তা দেখার জন্যে। কাপড় তুলতে তুলতে নিঃশব্দে দেখে চলে যাবেন এই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। তিনি খোলা জানালায় যে দৃশ্য দেখলেন তা দেখার জন্যে তাঁর কোন মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি দেখলেন চিত্রা দুহাতে জোবেদ আলির হাত চেপে ধরে আছে এবং ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। জোবেদ আলি মূর্তির ভঙ্গিমায় বসে আছেন।
সুরমা সম্বিৎ ফিরে পেয়েই দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। সারা বিকাল তাঁর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সন্ধ্যায় প্রচন্ড মাথা ধরল। রাতে তিনি কিছু খেতে পারলেন না। আজীজ সাহেব রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমুতে এলে সুরমা বললেন–জোবেদ সাহেবত্তে অনেকদিন থাকলেন এখন চলে যেতে বললে কেমন হয়?
আজীজ সাহেব চোখ সরু করে তাকালেন। স্ত্রীর সব কথাতেই তিনি চোখ সরু করেন। এবার যেন আরো বেশী সরু করলেন।
বোকার মত কথা বলবে না। একজন ভদ্রলোককে খামাখা চলে যেতে বলব কেন? অসুবিধাটা কি? মাসে মাসে দু হাজার টাকা পাচ্ছ? এটা সহ্য হচ্ছে না? তুমি হুঁড়ি পাতিল নিয়ে আছ হাঁড়ি পাতিল নিয়ে থাক।
সুরমা তারপরেও ক্ষীণ গলায় বললেন, একজন পুরুষ মানুষ ছাদে থাকেমেয়েরা ছাদে কাপড় শুকুতে যায়।
তাতে হয়েছে কি?
না কিছু হয় নি।
কাকে ভাড়া দেব কাকে দেব না এইসব চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। চিন্তার মানুষ আছে।
আচ্ছা।
বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে আস।
সুরমা বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন ঠিকই তার এক ফোটা ঘুম হল না। এক রাতে চারবার চিত্রার শোবার ঘরে গেলেন দেখার জন্যে চিত্রা ঘরে আছে কি-না। তাঁর মনে হল বাকি জীবনে তিনি আর কখনোই রাতে ঘুমুতে পারবেন না।