চিত্রা পাথর নিয়ে বের হয়ে এল। সিড়ি দিয়ে নামার সময় পাথরটা সে গালে চেপে রাখল। তার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে আসছে।
২.
তোর কোলে এটা কি?
চিত্রা মার দিকে না তাকিয়ে সহজ গলায় বলল, পাথর। এর ইংরেজী নাম Stone.
সুরমা বিস্মিত গলায় বললেন, পাথর কোলে নিয়ে বসে আছিস কেন?
চিত্রা এবার মার দিকে তাকাল। শান্ত গলায় বলল, বাংলাদেশ সংবিধানে এমন কোন ধারা আছে যে পাথর কোলে নিয়ে বসে থাকা যাবে না?
সব কথায় তুই এমন পাচালো জবাব দিস কেন? সরাসরি জবাব দিতে অসুবিধা কি? রশীদ আমাকে বলল, তুই নাকি সারাক্ষণ একটা পাথর নিয়ে ঘুরিস। আমি তার কথা বিশ্বাসই করিনি। এখন দেখছি সত্যি।
পাথর নিয়ে ঘোরা কোন বড় অপরাধের মধ্যে পড়ে না মা। পাথর ছুঁড়ে করো মাথার ঘিলু বের করে দিলে বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় মামলা হবে। পাথরতো আমি ছুঁড়ে মারছি না। কোলে নিয়ে বসে আছি।
শুধু শুধু পাথর কোলে নিয়ে বসে আছিসই বা কেন?
আচ্ছা যাও আমি পাথর রেখে আসছি, অকারণে চেঁচিওনাতো মা।
চিত্রা পাথর নিয়ে তার ঘরে ঢুকে পড়ল। সুরমা শংকিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শংকিত হবার তার যথেষ্ট কারণ আছে। পাথর নিয়ে চিত্রার বাড়াবাড়িটা আজ না অনেক আগেই তার চোখে পড়েছে। তিনি কিছু বলেন নি। ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করেছেন। সুরমা এই সংসারে বেকার একটা ভাব ধরে থাকেন। সংসার পরিচালনায় এতে তাঁর খুব লাভ হয়। বোকাদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে সবাই অসাবধানে থাকে। তাতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
চিত্রা যে জোবেদ আলি নামের আধবুড়ো মানুষটার জন্যে পাগল হয়ে আছে তা তিনি বুঝেছেন চিত্রার বোঝার আগেই। কিন্তু যেহেতু সংসারে তিনি বোকা সেজে থাকেন সেহেতু চিত্রাকে কিছু বুঝতে দেন নি। চিত্রা তাঁকে ভুলার জন্যে নানান ধরনের অভিনয় করছে। খুব কাঁচা অভিনয়। যখন তাকে বলা হয় যাতে জোবেদ সাহেবকে এক কাপ চা দিয়ে আয় কিংবা এই হালুয়াটা দিয়ে আয় সে বলবে— আমি পারব না মা। আমার উপরে যেতে ইচ্ছা করে না। তিনি যতই জুড়াজুড়ি করবেন সে ততই না করবে শেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে যাবে। ফিরবে এক থেকে দুঘন্টা পর।
এইসব লক্ষণ খুবই খারাপ। অল্প বয়সের ভালবাসা অন্ধ গভারের মত শুধুই একদিকে যায়। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, আদর দিয়ে এই গন্ডার সামলানো যায় না। সুরমা আতংকে অস্থির হয়ে আছেন। আতংকট প্রকাশ করছেন না। পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। সমস্যাটা ভালমত বুঝতে পারলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যাবে। সমস্যাটা ভালমত বুঝতেও পারছেন না।
জোবেদ আলি সাহেবের ভূমিকার্ট এখানে কি? ভদ্রলোক অতি বুদ্ধিমান। চিত্রার সমস্যাটা তাঁর বুঝতে না পারার কথা না। তিনি কি মেয়েটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? না সমস্যাটা সামলাবার চেষ্টা করছেন? একজন দায়িত্বশীল বিচক্ষণ ভদ্রলোক এইসব ব্যাপার কখনো প্রশ্রয় দেবেন না। তাঁর বড় মেয়ের বয়স চিত্রার চেয়ে বেশী। প্রশ্রয় দিতে গেলে এই কথাটা তাঁর অবশ্যই মনে পড়বে। তবে ভদ্রলোকের নিজের মনেও যদি কোন রকম দুর্বলতা জমে থাকে তাহলে তিনিও অন্ধ গন্ডারের মত আচরণ করবেন। পাথরের যে দেবত সেও পূজা গ্রহণ করে, মানুষ কেন করবে না?
এখন যা করতে হবে তা হল ভদ্রলোককে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এই কাজটা তিনি করতে পারবেন না, চিত্রার বাবাকে দিয়ে করাতে হবে। তবে চিত্রার বাবাকে আসল কথা কিছুই বলা যাবে না। মেয়ের পাগলামী মানুষটার কানে গেলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। সুরমা তাঁর সংসারে ভয়ংকর কিছু চান না।
সুরমা রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে চিত্রার ঘরে গেলেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করবেন। গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জোবেদ আলি সম্পর্কে কিছু কথা বলে দেখবেন মেয়ের মুখের ভাব বদলায় কিনা। দরকার হলে আজ রাতে মেয়ের ঘরে ঘুমুবেন।
চিত্রা মশারী খাটিয়ে শুয়ে পরার আয়েজন করছিল। চিত্রা মাকে দেখে বলল, কি হয়েছে মা?
সুরমা হাই তুলতে তুলতে বললেন, আজ তোর সঙ্গে ঘুমুবরে মা।
আমার সঙ্গে ঘুমুবে কেন?
তোর বাবার সঙ্গে ঝগড়ার মত হয়েছে। এই জন্যে।
অসম্ভব। মা তুমি আমার সঙ্গে ঘুমুতে পারবে না। তোমার গা থেকে মশলার গন্ধ আসে।
কি বলিস তুই, গা থেকে মশলার গন্ধ আসবে কেন?
সারাদিন রান্নাবান্না নিয়ে থাক মশলার গন্ধতে আসবেই–এখন আসছে হলুদ অরি পেয়াজের গন্ধ। তাছাড়া মা তিনজনের এক বিছানায় জায়গাও হবে না। বিছানা ছোট।
সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, তিনজন কোথায়?
আমি, তুমি আর পাথর। পাথরটা রাতে আমার সাথে ঘুমায়।
পাথর রাতে তার সঙ্গে ঘুমায়?
হ্যাঁ।
আমারতো মনে হয় তুই পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছিল।
পাগল হব কেন? পাথর সঙ্গে নিয়ে ঘুমালেই মানুষ পাগল হয়ে যায় না। তুমি কি পুতুল সঙ্গে নিয়ে ছোটবেলায় ঘুমুতে না? পাথরটা হচ্ছে আমার পুতুল।
পাথরটাকে তুই গোসল দিসঃ রশীদ আমাকে বলছিল।
রশীদতো দেখি বিরাট বড় ভাই হয়েছে। কি করি না করি সব রিপোর্ট করছে।
পাথরটাকে তুই গোসল দিস কি-না সেটা বল।
হুঁ দেই।
কেন?
এম্নি দেই মা। এই একটা খেলা। মজার খেলা। আমারতো খেলার কেউ নেই কাজেই পাথর নিয়ে খেলা। তুমিতো আর আমার সঙ্গে খেলবে না।
সুরমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চিত্রার মশারি খাটানো শেষ হয়েছে। সে তার পড়ার টেবিল থেকে পাথরটা নিয়ে বালিশে শুইয়ে দিয়ে মার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, এসো ঘুমুতে এসো মা। রাত প্রায় বারোটা বাজে।