জোবেদ আলি বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ভেতরে এসো। সাত মিনিট দেরী হল যে?
দেরী মানে?
আমি জানতাম তুমি আমার ঘরে ঠিক এগারোটার সময় চা নিয়ে আসবে। এখন বাজছে এগারোটা সাত। কাজেই তুমি সাত মিনিট দেরী করেছ?
আমি ঠিক এগারোটার সময় আসব আপনাকে কে বলল?
আমার সিক্সথ সেন্স বলেছে।
উফ কেন যে মিথ্যা কথা বলেন। আপনি কি ভেবেছেন আপনার মিথ্যা কথা শুনে আমি খুশি হব?
আমি যে কথাটা বললাম সেটা যে মিথ্যা না তা কিন্তু আমি প্রমাণ করে দিতে পারি।
বেশতো প্রমাণ করুন।
টেবিলের উপরে দেখ একটা বই আছে জীবনানন্দ দাসের কবিতাসমগ্র। বইটার নিচে একটা কাগজ আছে। কাগজটায় কি লেখা আছে পড়ে।
চিত্রা কাগজটা নিয়ে পড়ল। কাগজে লেখা- আমার সিক্সথ সেন্স বলছে চিত্রা ঠিক এগারোটায় আমার জন্যে চা নিয়ে আসবে। আমি চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি।
পড়েছ?
হ্যাঁ।
আজকের তারিখ দেয়া আছে দেখেছ?
হ্যাঁ।
অবাক হয়েছ?
হ্যাঁ।
কতটুক অবাক হয়েছ?
চিত্রা চাপা গলায় বলল, খুব অবাক হয়েছি।
বিস্ময় অভিভূত?
হ্যাঁ।
জোবেদ আলি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসি মুখে বললেন, এত অল্পতে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে না। পরে সমস্যায় পরবে। সিক্সথ সেন্স টেন্স কিছু না। আমি যা করেছি তা হচ্ছে খুব সাধারণ একটা ট্রিকস। অনেকগুলি কাগজে এই জিনিস লিখেছি শুধু সময়টা একেক কাগজে একেক রকম। তুমি যদি বারটার সময় চা নিয়ে আসতে তাহলে বলতাম জানালার কাছে যে পিরিচটা আছে সেই পিরিচের নিচের কাগজটা দেখ। সেই কাগজে লেখা চিত্রা ঠিক বারটার সময় আমার জন্যে চা নিয়ে আসবে। এখন বুঝতে পারছ?
এটা কেন করলেন?
তোমার বিষ্ময়ে অভিভূত করে দেবার জন্যে করলাম।
কৌশলটা পরে বলে ফেললেন–বিষ্ময়টাতো আর রইল না।
কৌশলটা স্বীকার করায় বিস্ময় আরো দীর্ঘস্থায়ী হল। বিস্ময়ের সঙ্গে যুক্ত হল মজা। তাই না?
হ্যাঁ।
গম্ভীর হয়ে আছ কেন?
রাগ লাগছে।
রাগ লাগছে কেন?
আপনার এত বুদ্ধি আর আমার এত কম। বুদ্ধি এই জন্যে রাগ লাগছে।
তোমার বুদ্ধি কম কে বলল?
আমি জানি আমার বুদ্ধি কম। আমি মোটর সাইকেলের মত ফটফট করে কথা বলতে পারি কিন্তু আমার বুদ্ধি কম। আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে কাউকে বোকা বানাতে পারি না। শুধু মাকে পারি।
উনাকে বোকা বানাও?
হ্যাঁ মার ধারণা আপনাকে আমার একেবারেই পছন্দ না।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আমার বুদ্ধি কম হলেও আমি আবার ভাল অভিনয় জানি। আমি নানান ধরনের অভিনয় করে মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখি। মার ধারণা আমি আপনাকে দেখতে পারি না।
আসলে পার?
চিত্রা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। জোবেদ আলি টের পাচ্ছেন মেয়েটি রেগে যাচ্ছে। তিনি রাগ কমানোর চেষ্টা করলেন না। মাথা নীচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন। চিত্রা বলল, আপনার বই লেখা কেমন এগুচ্ছে?
ভাল।
এখন কি লিখছেন?
সৌন্দর্য কি? এই বিষয়ে একটা লেখা?
সৌন্দর্য কি?
জোবেদ আলি হাসি মুখে বললেন, তাতো জানি না।
যা জানেন না তার উপর লিখছেন কি ভাবে?
সৌন্দর্য কি তা যে আমি জানি না সেটাই লেখার চেষ্টা করছি।
আপনার কথা বুঝলাম না।
সব কথা যে বুঝতেই হবে এমন তো না। কথা না বোঝার মধ্যেও আনন্দ আছে।
আমি এখন চলে যাব।
আচ্ছা।
আমার মনটা খুব খারাপ আপনি আমার মন ভাল করে দিন।
মন কি ভাবে ভাল করব তাতো বুঝতে পারছি না। প্রবন্ধ যেটা লিখছি সেটা পড়ে শুনাব?
না।
চিত্রা ওঠে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে বলল, আমি যাচ্ছি। জোবেদ আলি বললেন, এমন রাগী রাগী ভাব করে চলে যেও না তারপর দেখবে নিজেরই খারাপ লাগবে। খানিকক্ষণ বসে মনটা ভাল করে তারপর যাও।
আমার মন ভাল হবে না।
মন ভাল হবার ব্যবস্থা করছি।
কি ব্যবস্থা?
তোমাকে একটা উপহার দিচ্ছি। উপহার পেলে মেয়েদের মন ভাল হয়।
খুব ভুল কথা বলেছেন। মেয়েদের এত ছোট করে দেখবেন না। মেয়েরা উপহারের কাঙ্গাল না।
আমি যে উপহার দেব তা পেয়ে তুমি অসম্ভব খুশি হবে তা আমি লিখে দিতে পারি।
উপহারটা কি?
জোবেদ আলি উঠলেন। টেবিলের ড্রয়ার খুলে বেশ বড় সাইজের একটা পাথর বের করে আনলেন। বিশেষত্বহীন পাথর। এইসব পাথর ভেঙ্গেই রেল লাইনে দেয়া হয়। দালান কোঠা তৈরীতে ব্যবহার হয়। এর বেশী কিছু না। চিত্রা আগ্রহী গলায় বলল, এই আপনার উপহার?
হ্যাঁ।
আপনার ধারণা এই পাথর পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা হব?
হ্যাঁ হবে। কারণ এই পাথরে কিছু লেখা আছে।
কি লেখা?
চিত্রা গভীর আগ্রহে পাথর হাতে নিল। কোন লেখা দেখতে পেল না। সারা পাথরের গায়ে বল পয়েন্টে অসংখ্য গুণ চিহ্ন আঁকা।
এই গুণ চিহ্নের মানে কি?
জোবেদ আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে হাসি মুখে বললেন, একটা গুণ চিহ্ন আঁকতে দুটা দাগ দিতে হয়। দুটা দাগ মানে দুজন মানুষ। দুটা দাগ দুদিকে— তার মানে মানুষ দুজন ভিন্ন প্রকৃতির। একটা জায়গায় দাগ দুটি মিলেছে— তার মানে হল দুটি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ একটা জায়গায় মিলেছে। অর্থাৎ একটি ক্ষেত্রে তারা এক ও অভিন্ন। এরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে।
চিত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। জোবেদ আলি বললেন, উপহার পছন্দ হয়েছে?
চিত্রা গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ।
জোবেদ আলি বললেন, তুমি বেশ কিছুদিন আগে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলে আমি ভেবেছিলাম কোনদিন সেই চিঠির জবাব দেব না। আজ এই পাথর দিয়ে জবাব দিলাম।
চিত্রা ধরা গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু। আমি খুব খুশী হয়েছি।
বেশ তাহলে এখন যাও। আমি এখন সৌন্দর্য বিষয়ে আমার অজ্ঞতা প্রসঙ্গে লেখাটা শেষ করব।