চিত্রা খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, ছাদে কি করছেন?
জোবেদ আলি বললেন, হাঁটছি।
আপনি রোজ এত ভোরে উঠেন?
না। আজ বাধ্য হয়ে উঠেছি। দাঁতের ব্যথায় রাতে ঘুম হয়নি। দেখ গাল ফুলে কি হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সের অনেক যন্ত্রণা।
দাঁতের ব্যথাটা কি খুব বেশি?
এখন একটু কম। সব ব্যথাই দিনে কমে যায়। রাতে বাড়ে! তুমি কি রোজ এত ভোরে ওঠ?
আমি সকাল দশটার আগে কখনো বিছানা থেকে নামি না।
আজ নামলে যে?
চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, কাল রাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। এখন ঘুম পাচ্ছে। ঠিক করেছি ছাদে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শুয়ে পড়ব।
কাল রাতে ঘুম হয়নি কেন?
সত্যি জানতে চান?
জানতে চাই এইটুকু বলতে পারি। সত্যি জানতে চাই, না মিথ্যা জানতে চাই তা বলতে পারি না।
কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি কারণ কাল রাতে আমি টের পেলাম একজন মানুষকে আমি প্রচণ্ড রকম ভালবাসি। আপনি কি আমার কথায় অস্বস্তি বোধ করছেন?
অস্বস্তি বোধ করব কেন? তোমার বর্তমান সময়টা প্রেমে পরার জন্যে আদর্শ সময়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়ে গেছে, কিছু করার নেই–এই সময় প্রেমে পরবে নাতো কখন পরবে? প্রেমে কি একা একা পরেছ না দুজন মিলে পরেছ?
আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন প্রেমে পরাটা খালে পরে যাবার মত।
অনেকটা সে রকমই। কেউ কেউ এমন খালে পরে সেখানে হাঁটুপানি। সমস্যা হয় না। খাল থেকে উঠে আসতে পারে। আবার কোন কোন খালে অতলান্তিক পানি। উঠার উপায় নেই। সাঁতার জানলেও লাভ হয় না। কতক্ষণ আর সাঁতার কাটবে? এক সময় না এক সময় ডুবতে হবেই।
চিত্রা বলল, আবার কোন খালে পানি নেই। শুধুই কাদা। সেই খালে পরা মানে নোংরা কাদায় মাখামাখি হওয়া।
ভাল বলেছ। খুব গুছিয়ে বলছ।
আপনার সঙ্গে থেকে আর কিছু শিখি বা না শিখি গুছিয়ে কথা বলা শিখেছি।
তাওতো কিছু শিখলে। ভালটা মানুষ সহজে শিখতে পারে না। মন্দটা শিখে ফেলে। আমার মন্দ কিছু শেখনি?
আপনার মন্দ কি আছে?
অসংখ্য। প্রথম হল আলস্য। আমার মত অলস মানুষ তুমি তিন ভূবনে পাবে।
অলস কোথায়? আপনি দিন রাত বই পড়ছেন। লিখছেন।
আলস্যটাকে আড়াল রাখার এ হচ্ছে হাস্যকর একটা চেষ্টা। লোকে ভাববে অনেক কাজ করা হচ্ছে আসলে লবডঙ্গা।
লবডঙ্গা কি?
লবডঙ্গা হচ্ছে নব উংকা শব্দের অপভ্রংশ। নব ডংকা মানেতো জানই নতুন ঢোল। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না প্রচন্ড ঢোলের শব্দ হচ্ছে, সবাই ভাবছে না জানি কত কাজ হচ্ছে আসলে ঢোল বাজছে।
আমি এখন যাচ্ছি।
কি করবে ঘুমুবে?
আমার মাথা ধরে আছে। প্রথমে কড়া এক কাপ চা খেয়ে মাথা ধরাটা কমাব তারপর দুটা ঘুমের অসুধ খেয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবব কি করা যায়।
কি করা যায় মানে?
একটা মানুষকে যে আমি প্রচন্ড রকম পছন্দ করি তাকে কি করে সেই খবরটা দেয়া যায় তাই ভাবব। আপনিতো খুব জ্ঞানী মানুষ আপনার কি কোন সাজেশন আছে?
তাকে চিঠি লিখ। সুন্দর করে গুছিয়ে চিঠি লেখ।
অসম্ভব। আমি চিঠি লিখতে পারব না!–আমার লজ্জা লাগবে।
মুখে বলা কি সম্ভব ধর টেলিফোনে জানিয়ে দিলে।
না।
আমিতো আর কোন পথ দেখছি না।
আপনার ধারণা চিঠি লিখে জানানোই সবচে ভাল।
হ্যাঁ।
তারপর সে যদি সেই চিঠি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায় তখন কি হবে?
খানিকটা রিস্কতো নিতেই হবে।
আমি চিঠি লিখতে পারি না। আমি ভাল আছি তুমি কেমন আছ এই দুলাইন লেখার পর আমার চিঠি শেষ হয়ে যায়।
তাহলে এক কাজ কর রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার নাও। রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা কয়েক লাইন লিখে পাঠিয়ে দাও। এমন কিছু লাইন বের কর যাতে তোমার মনের ভাব প্রকাশিত হয়।
আমি পারব না। আপনি বের করে দিন।
লেখ—
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।
লেখার সময় খেয়াল রাখবে যেন বানান ভুল না হয়। প্রেমপত্রে বানান ভুল থাকা অমার্জনীয় অপরাধ।
বানান ভুল হবে না। চিঠি লিখতে না পারলেও আমি বানান খুব ভাল জানি।
চিত্রা ছাদ থেকে নেমে নিজেই চা বানিয়ে খেল। মাকে গিয়ে বলল–মা শোন, আমি এখন চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুম দেব। খবর্দার আমাকে নাশতা খাবার জন্যে ডাকাডাকি করবে না। আমি একেবারে দুপুরবেলা উঠে ভাত খাব।
সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে হবে কেন?
চিত্রা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি ঠিক করেছি একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে মারা যাব। আজ তার একটা রিহার্সেল।
তুই সব সময় এমন পাগলের মত কথা বলিস না।
আমি শুধু পাগলের মত কথাই বলি না, পাগলের মত কাজও করি। মা রশীদকে তুমি আমার ঘরে একটু পাঠাওতো।
কেন?
কাজ আছে।
চিত্রা নিজের ঘরে ঢুকে চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেল। তারপর ড্রয়ার থেকে কলম বের করে গোটা গোটা হরফে লিখল
প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস।
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
কাগজটা ভাজ করে রশীদের হাতে দিয়ে বলল–রশীদ তুই এ কাগজটা জোবেদ চাচার হাতে দিয়ে আয়। এক্ষুনী যা! কাগজটা দিয়ে এসে আমাকে খবর দিবি কাগজ দিয়ে এসেছিস। হাবার মত এরকম হা করে থাকবি না। মুখ বন্ধ কর।
চায়ের কাপ হাতে চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছে? পাঁচ মিনিট? দশ মিনিট? নাকি তার চেয়েও বেশী। চা সম্ভবত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডাই ভাল। জোবেদ চাচা ঠাণ্ডা চা খান। চিত্রা তার জীবনে এই প্রথম একটা মানুষ পেল যে চা ঠাণ্ডা করে খায়। চিত্রা টুক টুক করে দরজায় দুবার টোকা দিল।