চিত্রা বাবাকে বলেনি জোবেদ নামের মানুষটাকে কিছু কঠিন কথা শুনাতে গেছে। কঠিন কথাও ঠিক না— অবহেলা সূচক কিছু কথা। যা থেকে মানুষটা ধরে নেবে—এখানে তার বাস সুখকর কিছু হবে না।
লোকটা চেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে বই পড়ছিল এবং পা নাচাচ্ছিল। চিত্রাকে দেখে পা নাচানোও বন্ধ করল না, বই থেকেও চোখ তুললনা। গম্ভীর গলায় বলল, কেমন আছ চিত্রা?
লোকটার পক্ষে তার নাম জানা বিচিত্র কিছু না। নামতো জানতেই পারে। হয়ত কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে। তারপরেও প্রথম আলাপেই পরিচিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করা, কেমন আছ চিত্রা, খুবই আশ্চর্যজনক।
এসো ভেতরে এসো। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই অলক্ষণ।
অলক্ষণ কেন?
প্রাচীন বাংলার বিশ্বাস–যে মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তার ঘরে সুজন ঢুকে না।
চিত্রা দরজা ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকল। এবং বেশ সহজ ভাবেই চৌকির উপর বসল। জোবেদ আলি নরম গলায় বললেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
ভাল, শুধু ইংরেজীটা খারাপ হয়েছে।
ইংরেজী এ খারাপ হলে কিছু যায় আসে না। ইংরেজী বিদেশী ভাষা। বাংলাটা ভাল হলেই ইল। ইংরেজি খারাপ হওয়া ক্ষমা করা যায়। বাংলা খারাপ হওয়া ক্ষমার অযোগ্য।
আমার বাংলাও খারাপ হয়েছে।
সেকি?
আসলে আমার সব পরীক্ষাই খারাপ হয়েছে। তবে বাসায় কাউকে কিছু বলি নি। বাসার সবাই জানে আমার সব স্ত্রীক্ষা ভাল হয়েছে। শুধু ইংরেজীটা একটু খারাপ হয়েছে। আমি যা বলি সবাই আবার তা বিশ্বাস করে। কারণ আমি হচ্ছি খুব ভাল অভিনেত্রী।
তাই নাকি?
জ্বি।
মাঝে মাঝে আমার নিজের অভিনয় দেখে মনে হয় আমি সুবর্ণা মুস্তফার চেয়েও ভাল অভিনয় করি। আমার চেহারাটা যদি আরেকটু মিষ্টি হত তাহলে টিভিতে যেতাম।
তোমার চেহারা মিষ্টি না?
জ্বি না।
বুঝলে কি করে চেহারা মিষ্টি না?
আমাকে রাতে কখনো পিপড়ায় কামড়ায় না। আমি মিষ্টি হলে রাতে নিশ্চয়ই পিপড়ায় কামড়াতো।
জোবেদ আলি হো হো করে হেসে ফেললেন। হাসির উচ্ছাসে তার হাত থেকে বই পড়ে গেল। চিত্রা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সামান্য রসিকতায় একটা মানুষ এত হাসতে পারে সে কল্পনাও করেনি। চিত্রা বলল, চাচা আমি যাই। জোবেদ আলি বললেন, অসম্ভব তুমি এখন যেতেই পারবে না। তোমাকে কম করে হলেও আরো পাঁচ মিনিট থাকতে হবে। আসলে আজ সকাল থেকে আমার মনটা খুব খারাপ ছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলে মনটা ভাল হয়েছে। আরেকটু ভাল করে দিয়ে যাও।
চিত্রা বলল, আমি কারোর মন ভাল করতে পারি না। আমি যা পারি তা হচ্ছে মন রাগিয়ে দেয়। যেই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে সেই রেগে যায়।
আচ্ছা বেশ তুমি আমাকে রাগিয়ে দিয়ে যাও দেখি কেমন রাগাতে পার। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হল
চিত্রা পাঁচ মিনিটের জন্যে বসে শেষ পর্যন্ত পুরো এক ঘন্টা থাকল। সে আরো কিছুক্ষণ থাকতো কিন্তু সুরমা রশীদকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন। চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, এতক্ষণ কি করছিলি?
চিত্রা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, মা শোন কাকে আমাদের বাড়িতে এনে ঢুকিয়েছ?
সুরমা বললেন, কেন?
আমি ভদ্রতা করে দেখা করতে গেলাম উনি আমাকে ইংরেজী ট্রানস্লেশন ধরলেন। তারপর উপদেশ আর বক্ততা। অসহ্য। বাবাকে বলে উনাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করবো মা! ঐ লোকের জন্য আমার ছাদে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।
তুই তোর মত ছাদে যাবি।
অসম্ভব! আমি আর ভুলেও ছাদে যাব না।
আসলে এক অর্থে চিত্রার ছাদে যাওয়ার সেদিন থেকেই শুরু। তারপর এক রাতে সে আশ্চর্য সুন্দর এবং একই সঙ্গে খুবই ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখল। সে দেখল সে হাঁটছে, ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে। সেই বাচ্চা মেয়েটা জাপানী পুতুলের মত সুন্দর। জোবেদ আলি নামের মানুষটা বাচ্চা মেয়ের অন্য হাত ধরে আছে। সেই মানুষটা বাচ্চা মেয়েটার বাবা, এবং সে মেয়েটার মা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জা। কি লজ্জা। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারারাত সে জেগে রইল।
নিজেকে মনে হচ্ছিল কুৎসিত একটা পোকা। সারারাত সে একটা পোকার মতই শরীর গুটিয়ে শুয়েছিল। শুয়ে শুয়েই সে ফজরের আজান শুনল। তার মা ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলছেন তাও বুঝল। এবং প্রথমবারের মত মনে হল— মা রোজ এত ভোরে উঠে আশ্চর্যতো। সে নিজেও বিছানা ছেড়ে নামল। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দেখে বারান্দার জলচৌকিতে সুরমা নামাজ পড়ছেন। বারান্দার এই অংশটা চিকের পর্দায় ঢাকা। খুব নিরিবিলি।
সুরমা নামাজ শেষ করে বিস্মিত হয়ে বললেন, কি হয়েছে? চিত্রা বলল, কিছু হয়নি। ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
এত সকালে ঘুম ভাঙ্গল কেন?
তুমি এমন ভাবে কথা বলছ যেন সকালে ঘুম ভাঙ্গাটা অপরাধ।
অপরাধ হবে কেন? সকালে ঘুম ভাঙ্গাটাতে খুব ভাল কথা। ফজরের দুরাকাত নামাজ পড়ে ফেলিস দেখবি সারাটা দিন কত ভাল যাবে। শরীর থাকবে ফ্রেস। আজ থেকে শুরু কর না।
সব সময় উপদেশ দিও নাতো মা। অসহ্য লাগে। আজ ভোরবেলায় উঠেছি বলে কি রোজ ভোরবেলায় উঠব? কাল থেকে আবার আগের মত দশটার সময় ঘুম ভাঙ্গব।
তুই যাচ্ছিস কোথায়?
ছাদে। মর্নিং ওয়ার্ক করব।
তোর চোখ এমন লাল দেখাচ্ছে কেন?
ভোরবেলা সবার চোখই লাল দেখায়। তোমার চোখও লাল। বাম চোখটা বেশি। ডানটা কম।
চিত্রা ছাদে উঠে গেল।
আশ্চর্য জোবেদ আলি সাহেব ছাদে হাঁটছেন। তাঁর পরণে ফুল হাতা সার্ট। ধবধবে সাদা লুঙ্গী। সার্টের রঙ খয়েরী। খয়েরী রঙের খানিকটা মুখে এসে পড়েছে। তাকে কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।