জোবেদ আলি সুরমাদের তিন তলা বাড়ির ছাদে থাকেন। ছাদে চিত্রার বাবা আজীজ সাহেব বাথরুমসহ একটা ঘর বানিয়ে ছিলেন। গেষ্ট রুম। গেষ্ট এলে ছাদে থাকবে মূল বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না। মাঝে মাঝে নিজেরাও থাকবেন। বৃষ্টি বাদলার দিনে ছাদের চিলেকোঠায় থাকতে ভালই লাগে। সেই পরিকল্পনা কাজে লাগলো না। আজীজ সাহেবের মাথায় অর্থকরী পরিকল্পনা খেলা করতে লাগল। ছাদের ঘরটা ভাড়া দিলে কেমন হয়। নিঝনঝট টাইপের ভাড়াটে পাওয়া গেলে প্রতি মাসে হেসে খেলে দুহাজার টাকা পাওয়া যাবে বছরে চব্বিশ। হাজার, দশ বছরে দুইলাখ চল্লিশ হাজার। আজীজ সাহেব এক রুম ভাড়া হবে এমন একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। বর্তমান ভাড়াটে জোবেদ আলি সেই বিজ্ঞাপনের ফসল। ভদ্রলোকের বয়স তিপ্পান্ন। ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। ভাল না লাগায় ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে বই পড়া এবং লেখালেখি ছাড়া কিছুই করেন না। এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে বলেন, যেভাবে বেঁচে আছি এইভাবে আরো দশ বছর বেঁচে থাকার মত অর্থ আমার আছে। দশ বছরের বেশি বেঁচে থাকব বলে মনে হয় না। যদি বেঁচে থাকি তখন দেখা যাবে।
আদর্শ ভাড়াটে বলে যদি পৃথিবীতে কিছু থেকে থাকে জোবেদ আলি তাই। তিনি কোথাও যান না, কেউ তাঁর কাছে আসে না। দুপুর বা মধ্যরাতে হঠাৎ টেলিফোন করে কেউ বলে না—আপনাদের ছাদে যে ভদ্রলোক থাকেন জোবেদ আলি তাকে একটু ডেকে দিন না। শুরুতে আজীজ সাহেব বলে দিয়েছিলেন— ভাই মাসের দু তারিখে ভাড়া দিয়ে দেবেন। এক বছর হয়ে গেল জোবেদ আলি তাই করছেন খামে ভর্তি করে কুড়িটা একশ টাকার নোট দিচ্ছেন। প্রতিটি নোট নতুন। কোন ময়লা নোট বা স্কচটেপ লাগানো নোট তার মধ্যে নেই। ভাড়াটের নানান অভিযোগ থাকে—এই ভদ্রলোকের কোন অভিযোগও নেই। একবার পানির মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিন দিন পানি ছিল না। তিনি কাউকে কিছু বলেন নি। একতলা থেকে বালতি করে পানি এনেছেন। সুরমা দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিলেন। চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, একি আপনি পানি তুলবেন কেন? আমার ঘরে তিনটা কাজের মানুষ, বললেই পানি তুলে দেয়। জোবেদ আলি বলেছিলেন–ভাবী, আমি নিজেও একজন কাজের মানুষ। সামান্য এক বালতি পানি উপরে তোলার সামর্থ আমার আছে। যেদিন থাকবে না সেদিন আপনাকে বলব।
আজীজ সাহেব পৃথিবীর কোন মানুষকে বিশ্বাস করেন না, পছন্দও করেন না। তার ধারণা আল্লাহতালা মানুষকে বদ হিসেবে বানিয়েছেন। ভাল যা হয় নিজের চেষ্টায় হয়— কিছুদিন ভাল থাকার পর আবার নিজের বদ ফরমে ফিরে যায়। সেই আজীজ সাহেবেরও ধারণা—জোবেদ আলি মানুষটা খারাপ না। সুরমা পৃথিবীর সব মানুষকে বিশ্বাস করেন। তার ধারণা জোবেদ আলি মানুষ হিসেবে শুধু ভাল না, অসাধারণ ভাল। শুধু একটু দুঃখি। তাতো হবেই ভাল মানুষরা দুঃখি দুঃখি হয়। ভদ্রলোকের একটা মাত্র মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে চলে গেল ভার্জিনিয়া। বাবা একা পরে রইল দেশে। বাবা এবং মেয়ের আর দেখা হবে কিনা কে জানে? সুরমা একবার কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলেন— আচ্ছা ভাই স্ত্রী মারা যাবার পর আপনি আবার বিয়ে করলেন না কেন? বিয়ে করলে তো আর এই কষ্টটা হত না। একা একা পড়ে আছেন ভাবতেই খারাপ লাগে।
ভদ্রলোক হাসিমুখে বলেছেন–ভাবী এটা একটা বড় ধরনের বোকামী হয়েছে। ব্যাপারটা আপনাকে বলি–আমার মেয়ের জন্মের পরপর স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ অবস্থায় এক রাতে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, শোন তুমি আমাকে একটা কথা দাও, যদি আমি মরে টরে যাই তুমি কিন্তু বিয়ে করতে পারবে না। আমি ঘুমের ঘোরে ছিলাম বলে ফেললাম, আচ্ছা। বলেই ফেঁসে গেছি। বেচারী তার মাসখানিক পর মারা গেল আমি ঝুলে গেলাম। হা হা হা।
সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, হাসছেন কেন? এর মধ্যে হাসির কি আছে?
ঘুমের ঘোরে একটা কথা বলে কেমন ফেঁসে গেলাম দেখেন না। এই জন্যই হাসছি।
ভাই আপনি বড়ই আশ্চর্য লোক।
আমি মোটেই আশ্চর্য লোক না ভাবী, আমি খুবই সাধারণ লোক। বেশি সাধারণ বলেই বোধহয় আশ্চর্য মনে হয়।
আপনার স্ত্রী কি খুব সুন্দরী ছিলেন?
সুন্দরী ছিল কিনা বলতে পারছি না, তবে অপুষ্টিজনিত কারণে বাঙ্গালী মেয়েদের চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব থাকে। সেই মায়া ভাবটা ডবল পরিমাণে ছিল এইটুকু বলতে পারি।
তাঁর ছবি আছে আপনার কাছে?
আমার কাছে নেই। আমার মেয়ের কাছে আছে। মার সব ছবি তার কাছে।
জোবেদ আলির প্রতি মায়ায় সুরমার হৃদয় দ্রবীভূত হল। বার মনে হল ইস মানুষটার জন্যে কিছু যদি করা যেত। যতই দিন যাচ্ছে সেই যা বাড়ছে।
চিত্রা চায়ের কাপ হাতে জোবেদ আলি সাহেবের ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার নিচের ঠোটটা কামড়ে ধরে আছে। তার কপালে ঘাম। সে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করছে যে অস্থিরতার কারণটাও তার কাছে ঠিক স্পষ্ট নয়। জোবেদ আলি চৌকিতে বসে আছেন। তার পিঠ দেয়ালে। পরণে লুঙ্গি ও ফুল হাতা সার্ট। ভদ্রলোকের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের একটি হচ্ছে ফুলহাতা শার্ট ছাড়া তিনি পরেন না। চিত্রার মনে হল-ইস ইনাকে কি সুন্দর লাগছে। এটা মনে হবার জন্যে সে লজ্জিতও হল না, অপ্রস্তুতও বোধ করল না।
অথচ প্রথমদিন মানুষটাকে দেখে খুব রাগ লেগেছিল। বাইরের উটকো একজন মানুষ ছাদের ঘরে পড়ে থাকবে। যখন তখন ছাদে আসা যাবে না। বৃষ্টিতে ছাদে গোসল করা যাবে না। বাবার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক করা যাবে না। বাবা কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে বলবেন, যা বোঝ না তা নিয়ে তর্ক করবে না। তোমার অভ্যাস হয়েছে তোমার মার মত না বোঝে তর্ক।