কেউ তার কথার কোনো জবাব দিল না। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী আকাশের চাদ। পরীকে অহেতুক লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্যেই হয়তো একখণ্ড বিশাল মেঘের আড়ালে তার সকল জোছনা লুকিয়ে ফেলল।
লম্বা-লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল আনিস। শেষরাতের ট্রেনটা যেন কিছুতেই মিস না হয়।
পাথর
চিত্রা মা, চা-টা উপরে দিয়ে আয়তো।
চিত্ৰা বারান্দায় বসে নখ কাটছিল। বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলের একটা নখ ভেঙ্গেছে, ভাঙ্গা নখ রিপেয়ার করা সহজ ব্যাপার না। তার সমস্ত মনযোগ সেই নখে। নখটা এমনভাবে কাটতে হবে যেন ভাঙ্গাটা চোখে না পড়ে। চিত্রা মার দিকে না তাকিয়েই বলল, দেখছ না মা একটা কাজ করছি।
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, কাজটা এক মিনিট পরে করলে হয় না?
চিত্রা বলল, হয় না। উপরে চা নিয়ে যাওয়ার চেয়ে আমার কাজটা অনেক বেশি জরুরী। তা ছাড়া উপরে চা নিয়ে যেতে আমার ভাল লাগে না।
সুরমা অবাক হয়ে বললেন, কেন?
জোবেদ চাচা সারাক্ষণ জ্ঞানের কথা বলেন। পড়া জিজ্ঞেস করেন। ইংলিশ ট্রানস্লেশন জিজ্ঞেস করেন। আমার অসহ্য লাগে।
তুইতো তার সঙ্গে বেশ হাসিমুখেই কথা বলিস।
আমি সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলি। অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে আরো বেশি হাসি মুখে বলি, যাতে তারা বুঝতে না পারে আমি খুব চমৎকার অভিনেত্রী। যাদের সঙ্গে আমি খারাপভাবে কথা বলি বুঝতে হবে তাদের আমি খুব পছন্দ করি। যেমন তুমি।
সুরমা বিরক্ত মুখে চায়ের কাপ নিয়ে চলে যাচ্ছেন। সকাল বেলার এই কাজের সময়ে চিত্রার বকবকানি শোনার কোন অর্থ হয় না। মেয়েটার কথাবার্তা কাজ কর্মের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। বারান্দায় বসে নখ কাটছে। কাটা নখ ছড়িয়ে থাকবে— সে উঠে চলে যাবে।
চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। সুরমা উপরে পাঠানোর কোন ব্যবস্থা করতে পারছেন না। কাজের মেয়েটার জ্বর এসেছে। সে কাথামুড়ি দিয়ে কে কেঁ করছে। রশীদকে পাঠিয়েছেন বাজারে। এক কাপ চা উপরে পাঠানোর লোকের অভাবে নষ্ট হবে? তাঁর মনটা খুঁত খুঁত করছে। অপচয় তার একেবারেই সহ্য হয় না। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চা তাঁর পছন্দের পানীয় না। চা খাবার পর মুখ মিষ্টি হয়ে থাকে। মিষ্টি ভাবটা কিছুতেই যায় না।
চিত্রার নখ কাটা শেষ হয়েছে। তার মুখ হাসি হাসি। তার অভিনয়টা ভাল হয়েছে। মা সত্যি সত্যি ধরে নিয়েছেন সে জোবেদ চাচাকে খুবই অপছন্দ করে। সামান্য এক কাপ চাও সে উপরে নিয়ে যেতে রাজি না। অথচ সে ছটফট করছে কারণ এগারোটা প্রায় বাজে এখনো অদ্ভুত মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। এখন সে নিশ্চিন্ত মনে চা নিয়ে উপরে যেতে পারবে। খুব কম করে হলেও এক ঘন্টা কথা বলতে পারবে। চিত্রা রান্নাঘরে ঢুকল। বিরক্ত বিরক্ত মুখ করে বলল–
মা চা দাও। নিয়ে যাচ্ছি।
সুরমা গম্ভীর গলায় বললেন, তোকে নিতে হবে না।
অন্য একজনের চা তুমি চুক চুক করে খেয়ে ফেলছ আশ্চর্য!
শুধু শুধু কথা বলিস নাতো।
চিত্রা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, মা শোন, আমি এক ঘন্টার জন্যে ছাদে যাচ্ছি। ছাদে হাঁটাহাঁটি করব। এই এক ঘন্টায় কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। আর শোন তুমি আরেক কাপ চা বানিয়ে দাও—আমি জ্ঞানী চাচার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।
তোকে চা দিয়ে আসতে হবে না।
অবশ্যই হবে। না দেয়া পর্যন্ত আমার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করবে। সারাক্ষণ মনে হবে আহা আমার জন্যে বেচারা চা খাওয়া থেকে বঞ্চিত হল। অপরাধবোধ থেকে হবে গিল্ট কমপ্লেক্স। সেখান থেকে জটিল জটিল সব মনের রোগ তৈরি হবে। তারপর একদিন দেখা যাবে আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেছি। আমার মাথার ঘিলু চারদিকে ছিটকে পরে আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তুই সারাক্ষণ এত কথা বলিস কিভাবে? ছোট বেলায় তো এ রকম ছিলি না?
ছোটবেলায় কি রকম ছিলাম, হাবা টাইপের?
আর কথা বলিস না তো।
তুমি আমার সামনে থেকে সরেতো মা। আমি চা বানাব। আমার নিজেরো চা খেতে ইচ্ছে করছে। জ্ঞানী চাচার জন্যেও এক কাপ নিয়ে যাব। অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হব। ভাল কথা মা–আমার হাতের কাটা নখগুলি সারা বারান্দায় ছড়ানো—কাউকে দিয়ে পরিস্কার করিও নয়ত তুমিই আমার সঙ্গে খাছ খ্যাচ করবে।
চুপ করতো। চিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল। সে চায়ের কাপে চা ঢালছিল। হাসির কারণে চা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। ধমক দেয়ার বদলে সুরমা মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা এত সুন্দর! পিঠময় চুল ছড়িয়ে সে বসে আছে ঘর আলো হয়ে আছে। সুরমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এত সুন্দর হওয়া ভাল না।
মা।
কি?
তোমার কি ধারণা—আমাদের জ্ঞানী চাচা বোকা না বুদ্ধিমান?
বোকা হবে কেন? এসব কি ধরনের কথা?
একমাত্র বোকারাই সারাক্ষণ জ্ঞানীর মত কথা বলে। এই জন্যেই আমার ধারণা তিনি বেশ বোকা।
শুধু চা নিয়ে যাচ্ছিস কেন বিসকিট নিয়ে যা।
আমি কিসকিট ফিসকিট নিতে পারব না।
চিত্রা চা নিয়ে উঠে চলে গেল! সুরমা গেলেন বারান্দায় ছড়িয়ে থাকা নখ পরিস্কার করতে।
বারান্দা ঝকঝকে পরিস্কার। নখের একটা কণাও কোথাও পড়ে নেই। মেয়েটা কি যে করে। মায়ের সঙ্গেও ফাজলামী। রশীদ বাজার নিয়ে এসেছে। তিনি বাজার তুলতে গেলেন। রশীদকে দিয়ে একটা প্লেটে করে কয়েকটা বিসকিটও উপরে পাঠাতে হবে। কথাটা মনে থাকলে হয়। তার কিছুই মনে থাকে না। বাজার তুলতে তুলতে আসল কথাটাই ভুলে যাবেন। পুঁই শাকের বড় বড় পাতা আনতে বলেছিলেন। এনেছে কি না কে জানে? হয়ত ভুলে বসে আছে। চিত্রার বাবা ইলিশপাতুরি খেতে চেয়েছিলেন। সরিষাও আনা দরকার ছিল। পুরানো সরিষায় তিতকুট ভাব হয়। পাতুরি বানালে জোবেদ সাহেবকে পাঠাতে হবে। ভাল মন্দ রান্নার সময় ভদ্রলোকের কথা মনে হয়— শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয় না। আসল সময়ে ভুলে যান। সুরমার মনে হল ডায়াবেটিসের সঙ্গে জরুরী বিষয় ভুলে যাবার একটা সম্পর্ক আছে। ডায়াবেটিস ধরা পরার পর থেকে এ রকম হচ্ছে। না আজ জোবেদ সাহেবকে খাবার পাঠাতেই হবে।