আনিসের বাবা বললেন, কাল বিকালে না হয় ছেলেটাকে খবর দিয়ে আনি। তুই দেখ।
কাল বিকাল পর্যন্ত তো থাকব না বাবা। আজ শেষরাতেই যাব।
সে কী!
ছুটি নিয়ে আসি নি তো। কোম্পানি একটা কাজে পাঠিয়েছিল ময়মনসিংহ। অনেকদিন আপনাদের দেখি নাই। কাজটাও হয়ে গেল সকাল-সকাল। তাই আসলাম।
একটা দিন থাকতে পারিস না?
উঁহু। কাল অফিস ধরতেই হবে। প্রাইভেট কোম্পানি, বড় ঝামেলার চাকরি।
আনিস একটা নিশ্বাস ফেলল। সবাই চুপ করে গেল হঠাৎ। চার মাস পর এসেছে আনিস। আবার কবে আসবে কে জানে। আনিসের মা কাঁপা গলায় বললেন, তোর বড় সাহেবকে একটা টেলিগ্রাম করে দে না।
আনিস হেসে উঠল। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বলল, বড়কর্তা যদি কোনোমতে টের পায় আমি বাড়িতে এসে বসে আছি তাহলেই চাকরি নষ্ট হয়ে যাবে। গোসল করব মা, গা কুটকুট করছে।
কুয়োয় করবি? পানি তুলে দেবে?
উঁহু, পুকুরে করব। পুকুরে মাছ আছে রে আজিজ?
আছে ভাইজান। বড়-বড় মৃগেল মাছ আছে।
আনিসের পিছু-পিছু পুকুরপাড়ে সবাই এসে পড়ল। আনিসের বাবা আর মা পাড়ে বসে রইলেন। আজিজ ভীষণ গরম লাগছে এই বলে আনিসের সঙ্গে গোসল করতে নেমে গেল। ঝুনু ঘাটের উপর তোয়ালে আর সাবান নিয়ে অপেক্ষা করছে। আনিসের সবচেয়ে ছোটবোন ঝুনু, ঘুমিয়ে পড়েছিল। আনিস ভোর রাত্রে চলে যাবে শুনে তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে। সেও এসে চুপচাপ রুনুর পাশে বসেছে। শুধু পরী আসে নি। দুটি চুলোয় রান্না চাপিয়ে সে আগুনের আঁচে বসে আছে একাকী।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতে-হতে অনেক রাত ইল। আনিসকে ঘিরে গোল হয়ে সবাই বসে গল্প করতে লাগল। উঠোনে শীতল পাটিতে বসেছে গল্পের আসর। এর মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে রুনু ঘুমুচ্ছে। চমত্তার চাদনি, সেইসঙ্গে মিষ্টি হাওয়া। কারুর উঠতে ইচ্ছে করছে না। পরীর কাজ শেষ হয় নি। সে বাসনকোসন নিয়ে ধুতে গেছে ঘাটে। এক সময় রুনু বলল, ভাইজান এখন ঘুমোতে যাক মা। রাত শেষ হতে দেরি নেই বেশি। আনিসের বাবা বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা রে তুই ঘুমুতে যা। রুনু তুই বউ-মাকে পাঠিয়ে দে। বাসন সকালে ধুলেই হবে।
ঘরের ভিতর হারিকেন জ্বলছিল। আনিস সলতে বাড়িয়ে দিল। টুকুন কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। আনিস চুমু খেল তার কপালে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বর নাকি টুকুনের?
হুঁ।
কবে থেকে?
কাল থেকে। সর্দি জ্বর। ও কিছু না। ঘাম দিচ্ছে, এক্ষুনি সেরে যাবে।
আনিস পরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। পরীর লজ্জা করতে লাগল। পরী বলল, হাসছ কেন?
এমনি। পরী তোমার জনো শাড়ি এনেছি একটা। দেখ তো পছন্দ হয় কিনা।
পরী খুশি-খুশি গলায় বলল, অনেকগুলি পয়সা খরচ করলে তো।
শাড়িটা পর, দেখি কেমন তোমাকে মানায়।
রুনুর জন্যে একটা শাড়ি আনলে না কেন? বেচারির একটাও ভালো শাড়ি নেই।
পয়সায় কুলোলে আনতাম। আরেকবার আসার সময় আনব।
পরী ইতস্তুত করে বলল, আমার একা একা শাড়ি নিতে লজ্জা লাগবে। এইটি রুনুর জন্যে থাক! আরেকবার নিয়ে এসো আমার জন্যে।
আনিস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ থাক তবে, আজ রাতের জন্য পর না দেখি?
শাড়ির ভাঁজ ভেঙে যাবে যে। রুনু মনে করবে আমার জন্যে এনেছিলে পরে তাকে দিয়েছ।
আচ্ছা, তাহলে থাক।
পরী লজ্জিত স্বরে বলল, বিয়ের শাড়িটা পরব? যদি বল তাহলে পরি।
পরী লজ্জায় লাল হয়ে ট্রাঙ্কের তালা খুলতে লাগল। আনিস বলল, টুকুন দেখতে তোমার মতো হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ, আব্বা তাকে ছোট পরী ডাকে। আচ্ছা টুকুনের একটা ভালো নাম রাখ না কেন?
জরী রাখব তার নাম।
জরী আবার কেমন নাম?
তোমার সঙ্গে মিলিয়ে রাখলাম। পরীর মেয়ে জরী।
পরী হেসে উঠল। হাসি থামলে বলল, অন্যদিকে তাকিয়ে থাক, শাড়ি বদলাব।
কী হয় অন্য দিকে তাকালে?
আহ্ শুধু অসভ্যতা।
আনিস মাথা নিচু করে টুকুনকে আদর করতে লাগল। পরী হালকা গলায় বলল, দেখ তো কেমন লাগছে?
একেবারে লাল পরী।
ইশ, শুধু ঠাট্টা।
রান্নাঘর থেকে ধুপধাপ শব্দ উঠছে।
আনিস বলল, এত রাতে ধান কুটছে কেন?
ধান কুটছে না চাল ভাঙছে। তোমার জন্যে পিঠা তৈরি হবে।
নিশ্চয়ই রুনুর কাণ্ড।
আনিস পরীর হাত ধরে তাকে কাছে টানল। পরীর চোখে আবার পানি এসে পড়ল। গাঢ়স্বরে বলল, আবার কবে আসবে?
জুলাই মাসে।
কতদিন থাকবে তখন?
অ-নে-ক দিন।
তুমি এত রোগা হয়ে গেছে কেন? পেটের ঐ ব্যথাটা এখনো হয়?
হয় মাঝে-মাঝে।
টুকুন কেঁদে জেগে উঠল। পরী বলল, জ্বর আরো বেড়েছে। ও টুকুন সোনা, কে এসেছে দেখ। দেখ তোমার আব্ব এসেছে।
আনিস বলল, আমার কোলে একটু দাও তো পরী। আরে-আরে মেয়ের একটা দাঁত উঠেছে দেখছি। কী কাণ্ড! ও টুকুন, ও জরী, একটু হাস তো মা। ও সোনামণি, দেখি তোমার দাঁতটা?
টুকুন তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। তাই দেখে আনিস ও পরী দুজনেই হাসতে লাগল।
আমার জরী সোনা কথা শিখছে নাকি, পরী? হুঁ। মা বলতে পারে। আর পাখি দেখলে বলে, ফা ফা।
আনিস হো-হো করে হেসে উঠল যেন ভীষণ একটা হাসির কথা। হাসি থামলে বলল, আমার জরী তোমার চেয়েও সুন্দর হবে। তাই না পরী?
আমি আবার সুন্দর নাকি?
না, তুমি ভীষণ বিশ্রী।
আনিস আবার হেসে উঠল। তার একটু পরেই বাইরে কাক ডাকতে লাগল। আনিসের বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ও আনিস, ও আনিস।
জি বাবা।
এখন রওনা না দিলে ট্রেন ধরতে পারবি না বাবা।
আনিস টুকুনকে শুইয়ে দিল বিছানায়। পরী কোনো কথা বলল না।
আনিস বাইরে বেরিয়ে দেখল চাদ হেলে পড়েছে। জোছনা ফিকে হয়ে এসেছে। বিদায়ের আয়েজন শুধু হল। ঘুমন্ত ঝুনুকে আবার ঘুম থেকে টেনে তোলা হল। সে হঠাৎ বলে ফেলল, ভাবী আজ বিয়ের শাড়ি পরেছে কেন?