দিন। চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দিন।
আবার বিরক্ত হন কি-না কে জানে। এরা কাজের মানুষ, চিঠি দিয়ে বিরক্ত করাও ঠিক না। এই চায়ের কী হইল?
চা হচ্ছে না-কি?
জি, বানাতে বলে এসেছি। চায়ের ব্যবস্থা আমার বাড়িতে আছে। মাঝে-মধ্যে হয়। বিশিষ্ট মেহমানরা আসেন। এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসার সাহেব এসেছিলেন, বিরাট জ্ঞানী লোক। এদের দেখা পাওয়া তো ভাগ্যের কথা, কী বলেন স্যার?
তা তো বটেই।
চা চলে এল।
চা খেতে-খেতে এই গ্রামের অচিন বৃক্ষ কী করে এল সেই গল্প হেডমাস্টার সাহেবের কাছে শুনলাম। এক ডাইনি না-কি এই গাছের উপর ‘সােয়ার’ হয়ে আকাশপথে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার পানির পিপাসা হয়। এইখানে সে নামে। পানি খেয়ে তৃষ্ণা নিবারিত করে। পানি ছিল বড়ই মিঠা। ডাইনি তখন সন্তুষ্ট হয়ে গ্রামের লোকদের বলে— তোমাদের মিঠা পানি খেয়েছি, তার প্রতিদানে এই গাছ দিয়ে গেলাম। গাছটা যত্ন করে রাখবে। অনেক অনেক দিন পরে গাছে ফুল ধরবে। তখন তোমাদের দুঃখ থাকবে না। এই গাছের ফুল সর্বরোগের মহৌষধ। একদিন উপাস থেকে খালিপেটে এই ফুল খেলেই হবে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনি এই গল্প বিশ্বাস করেন?
হেডমাস্টার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না করার তো কিছু নাই।
যে যুগে মানুষ চাঁদে হাঁটাহাঁটি করছে সেই যুগে আপনি বিশ্বাস করছেন গাছে চড়ে ডাইনি এসেছিল?
জগতে অনেক আচানক ব্যাপার হয় জলাব। যেমন ধরেন ব্যাঙের মাথায় মণি। যে মণি সাত রাজার ধন। অন্ধকার রাতে ব্যাঙ এই মণি শরীর থেকে বের করে। তখন চারদিক আলো হয়ে যায়। আলো দেখে পোকারা আসে। ব্যাঙ সেই পোকা ধরে ধরে খায়।
আপনি ব্যাঙের মণি দেখেছেন?
জি জনাব। নিজের চোখে দেখা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।
আমি চুপ করে গেলাম। যিনি ব্যাঙের মণি নিজে দেখেছেন বলে দাবি করেন তাঁর সঙ্গে কুসংস্কার নিয়ে তর্ক করা বৃথা। তাছাড়া দেখা গেল ব্যাঙের মণি তিনি একাই দেখেন নি আমার আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকেও দেখেছে।
দুপুরে হেডমাস্টার সাহেবের বাসায় খেতে গেলাম। আমি এবং ইদরিশ। হেডমাস্টার সাহেবের হতদরিদ্র অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। প্রাইমারি স্কুলের একজন হেডমাস্টার সাহেবের যদি এই দশা হয় তখন অন্যদের না-জানি কী অবস্থা। অথচ এর মধ্যেই পোলাও রান্না হয়েছে। মুরগির কোরমা করা হয়েছে। দরিদ্র মানুষটির অনেকগুলি টাকা বের হয়ে গেছে এই বাবদে।
আপনি এসেছেন বড় ভালো লাগতেছে। আজ পাড়াগাঁয়ে থাকি। দু একটা জ্ঞানের কথা নিয়ে যে আলাপ করব সেই সুবিধা নাই। চারদিকে মূর্খের দল। অচিন বৃক্ষ থাকায় আপনাদের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসেন। বড় ভালো লাগে। কিছু জ্ঞানের কথা শুনতে পারি।
বেচারা জ্ঞানের কথা শুনতে চায়। কোনো জ্ঞজ্ঞানের কথাই আমার মনে এল না। আমি বললাম, রান্না তো চমৎকার হয়েছে। কে বেঁধেছে, আপনার স্ত্রীর
জি না জনাব। আমার কনিষ্ঠ ভগ্নী। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী।
সে-কী?
হার্টের বাল্বের সমস্যা। ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বলেছেন, লাখ দুই টাকা খরচ করলে একটা-কিছু করা যাবে। কোথায় পাব এত টাকা বলেন দেখি।
আমি চুপ করে গেলাম। হেডমাস্টার সাহেব সহজ ভঙ্গিতে বললেন, আপনি যখন আসছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিব। সে শহরের মেয়ে। মেট্রিক পাস।
তাই নাকি?
জি। মেট্রিক ফাস্ট ডিভিশন ছিল। টোটেল মার্ক ছয়শ এগারো। জেনারেল অঙ্কে পেয়েছে ছিয়াত্তর। আর চারটা নম্বর হলে লেটার হত।
হেডমাস্টার সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
ওর আবার লেখালেখির শখ আছে।
বলেন কী!
শরীরটা যখন ভালো ছিল তখন কবিতা লিখত। তা এই মূখের জায়গায় কবিতার মতো জিনিস কে বুঝবে বলেন? গ্লাপনি আসছেন দু-একটা পড়ে দেখবেন।
জি নিশ্চয়ই পড়ব।
মহসিন সাহেব বলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি একটি কবিতার কপি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন অনেক পত্রিকার সাথে তার যোগাযোগ আছে, ছাপিয়ে দিবেন।
ছাপা হয়েছে?
হয়েছে নিশ্চয়ই। কবিতাটা ভালো ছিল, নদীর উপরে লেখা। পত্রিকা-টত্রিকা তো এখানে কিছু আসে না। জানার উপায় নাই। একটা পত্রিকা পড়তে হলে যেতে হয় মশাখালির বাজার। চিন্তা করেন অবস্থা। শেখ সাহেবের মৃত্যুর খবর পেয়েছি দুদিন পরে, বুঝলেন অবস্থা।
অবস্থা তো খারাপ বলেই মনে হচ্ছে।
ও অচিন বৃক্ষ থাকায় দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ আছে। আসে ভাইসাব, আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলেন। সে শহরের মেয়ে। ময়মনসিংহ শহরে পড়াশোনা করেছে।
আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। অপরিচিতি অসুস্থ একজন মহিলার সঙ্গে আমি কী কথা বলব? ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে অচিন বৃক্ষ দেখতে যারা আসেন তাদের সবাইকে এই মহিলার সঙ্গেও দেখা করতে হয়।
মহিলার সঙ্গে দেখা হল।
মহিলা না বলে মেয়ে বলাই উচিত। উনিশ-কুড়ির বেশি বয়স হবে না। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। মানুষ নয় যেন মিশরের মমি। বিশিষ্ট অতিথিকে দেখে তার মধ্যে কোনো প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল না। তবে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। হেডমাস্টার সাহেব তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লেন। পরক্ষণেই হাসিমুখে বললেন, আপনাকে সালাম দিচ্ছে।
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। কিছু-একটা বলতে হয় অথচ বলার মতো কিছু পাচ্ছি না। মেয়েটি আবার বিড়বিড় করে কী যেন বলল, হেডমাস্টার সাহেব বললেন–রেনু বলছে আপনার খাওয়াদাওয়ার খুব কষ্ট হল। ওর কথা আর কেউ বুঝতে পারে না। আমি পারি।