বিয়ের রাতে নানা কিছু ভেবে প্রিয়াংকা আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ধ্বকধ্বক করে বুক কাঁপছিল। কপাল রীতিমতো ঘামছিল। মানুষটা সঙ্গে-সঙ্গে তা বুঝে ফেলেছিল। কাছে এসে ভারী গলায় বলল, ভয় করছে? ভয়ের কী আছে বল তো?
প্রিয়াংকার বুকের ধ্বকধ্বকানি আরো বেড়ে গেল। সে হ্যাঁ না কিছুই বলল না। একবার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা তখন নরম গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই। ঘুমিয়ে পড়। বলেই প্রিয়াংকার গায়ে চাদর টেনে দিল। তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। প্রিয়াংকার ভয় পুরোপুরি কেটে গেল এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে দেখে লোকটি অন্যপাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। খানিকক্ষণ জেগে থেকে প্রিয়াংকা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। লোকটি তখন পাশে নেই।
একটা মানুষকে চেনার জন্যে একুশ দিন খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু প্রিয়াংকার ধারণা মানুষটা ভালো, বেশ ভালো। এরকম একজন মানুষকে তার অসুখের কথাটা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অসুখটার সঙ্গে এই মানুষটার সম্পর্ক আছে। এই কারণেই তাকে বলা যাবে না। কিন্তু কাউকে বলা দরকার। খুব তাড়াতাড়ি বলা দরকার। নয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। কিছুটা পাগল সে বোধহয় হয়েই গেছে। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। সন্ধ্যা মেলাবার পর শরীর কাঁপতে থাকে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলেও তৃষ্ণা মেটে না। সামান্য শব্দে ভয়ংকর চমকে উঠে। সেদিন বাতাসে জানালার কপাট নড়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ে অস্থির হয়ে গোঙানির মতো শব্দ করল প্রিয়াংকা। হাতের চায়ের কাপ থেকে সবটা চা ছলকে পড়ল শাড়িতে। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিল না। কেউ থাকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হত। প্রিয়াংকার ছোটমামা যেমন অবাক হলেন।
তিনি প্রিয়াংকাকে দেখতে এসেছিলেন। তার দিকে তাকিয়েই বিস্মিত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে?
প্রিয়াংকা হালকা গলায় বলল, কিছু হয় নি তো। তুমি কেমন আছ মামা?
আমার কথা বাদ দে। তোকে এমন লাগছে কেন?
কেমন লাগছে?
চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?
কোনো ব্যাপার না মামা।
গালটাল ভেঙে কী অবস্থা! তুই কথাও তো কেমন অন্য রকমভাবে বলছিস।
কী রকমভাবে বলছি?
মনে হচ্ছে তোর গলাটা ভাঙা।
ঠাণ্ডা লেগেছে মামা।
প্রিয়াংকা কয়েকবার কাশল। মামাকে বুঝাতে চাইল যে তার সত্যি-সত্যি কাশি হয়েছে, অন্য কিছু না। মামা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। শীতল গলায় বললেন,
আর কিছু না তো?
না।
ঠিক করে বল।
ঠিক করেই বলছি।
প্রিয়াংকার কথায় তার মামী খুব আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হল না। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। চায়ের কাপে দুটা চুমুক দিয়েই রেখে দিলেন। যাইরে মা। বলেই কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। মামা চলে যাবার এক ঘণ্টার ভেতরই মামি এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে মামা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
মামি প্রিয়াংকাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। প্রায় চেঁচিয়েই বললেন, এক সপ্তাহ আগে তোকে কী দেখেছি আর এখন কী দেখছি? কী ব্যাপার তুই খোলাখুলি বল তো? কী সমস্যা?
প্রিয়াংকা শুকনো হাসি হেসে বলল, কোনো সমস্যা না।
মামি কঠিন গলায় বললেন,
তুই বলতে না চাইলে আমি কিন্তু জামাইকে জিজ্ঞেস করব। জামাই আসবে কখন?
ও আসবে রাত আটটার দিকে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না মামি। আমি বলছি।
বল। কিছু লুকুবি না।
প্রিয়াংকা প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি ভয় পাই, মামি।
কিসের ভয়?
কী যেন দেখি।
কী দেখিস?
নিজেও ঠিক জানি না কী দেখি।
ভাসা-ভাসা কথা বলবি না। পরিষ্কার করে বল কী দেখিস।
প্রিয়াংকা এক পর্যায়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মামি আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। আমি কী সব যেন দেখি।
সে কী দেখে তা তিনি অনেক প্রশ্ন করেও বের করতে পারলেন না। প্রিয়াংকা অন্য সব প্রশ্নের জবাব দেয় কিন্তু কী দেখে তা বলে না। এড়িয়ে যায় বা কাঁদতে শুরু করে।
তোর কি বর পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ।
সে কি তোকে ভয়-টয় দেখায়?
কী যে তুমি বল মামি, আমাকে ভয় দেখাবে কেন?
রাতে কি তোরা একসঙ্গে ঘুমাস?
প্রিয়াংকা লজ্জায় বেগুনি হয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ।
সে কি তোকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখে?
কী সব প্রশ্ন তুমি কর মামি?
আমি যা বলছি তার জবাব দে।
না জাগিয়ে রাখে না।
মামি অনেকক্ষণ থাকলেন। প্রিয়াংকাদের ফ্ল্যাট ঘুরে-ঘুরে দেখলেন। কাজের মেয়ে এবং কাজের ছেলেটির সঙ্গে কথা বললেন। কাজের মেয়েটির নাম মরিয়ম। দেশ খুলনা। ঘরের যাবতীয় কাজ সে-ই করে। কাজের ছেলেটির নাম জীতু মিয়া। তার বয়স নয়-দশ। এদের দুজনের কাছ থেকেও খবর বার করার চেষ্টা করা হল।
আচ্ছা মরিয়ম তুমি কি ভয়-টয় পাও?
না। ভয় পামু ক্যা?
রাতে কিছু দেখটেখ না?
কী দেখুম?
আচ্ছা ঠিক আছে–যাও।
প্রিয়াংকার মামি কোনো রহস্য ভেদ করতে পারলেন না। তার খুব ইচ্ছা ছিল জাভেদের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবেন, পরামর্শ করবেন। প্রিয়াংকার জন্যে পারা গেল না। সে কঁদো-কঁদো গলায় বলল, মামি তুমি যদি তাকে কিছু বল তাহলে আমি কিন্তু বিষ খাব। আল্লাহর কসম বিষ খাব। নয়তো ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব।
তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ, প্রিয়াংকা সত্যি বিষ-টিষ খেয়ে ফেলতে পারে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়—এই কথা লিখে একবার সে এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেলেছিল। অনেক ডাক্তার-হাসপাতাল করতে হয়েছে। এই কাণ্ড সে করেছিল অতি তুচ্ছ কারণে। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া করে। এই মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। তাকে কিছুতেই ঘটানো উচিত নয়।