ও মনা
এই কথাটি না জানলে
প্রাণে বাঁচতাম না।
ও মন ও মনা।
তুমি ভিখিরিকে দুটি টাকা দিলে।
তোমার কথা মনে হলেই কষ্ট হয়। ভালোবাসার কষ্ট আমার চেয়ে বেশি কে আর জানবে বল? তোমার ব্যথা আমি সত্যি-সত্যি অনুভব করেছিলাম।
তোমার স্যার যেদিন নিতান্ত সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, সুলতানা, আমার স্যুটকেসটা গুছিয়ে দাও। আমি ভোরে যাচ্ছি। তখন তোমার চোখে জল টলমল করে উঠল। তোমার স্যার সেদিকে লক্ষ্যও করলেন না। সহজ ভঙ্গিতে এসে বসলেন আমার বিছানার পাশে। গাঢ়স্বরে বললেন, আপনি জরীকে নিয়ে সমুদ্রের তীরে কিছুদিন থাকুন। ভালো হয়ে যাবেন।
আমি বললাম, না-না আমি যাব না। সমুদ্র আমার ভালো লাগে না। আপনারা দুজনে যান। সমুদ্রতীরে সব সময় দুজন করে যেতে হয়। এর বেশিও নয়, এর কমও নয়।
তোমার স্যার তৃপ্তির হাসি হাসতে লাগলেন। তুমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলে। একটি কথাও বললে না। আমি দেখলাম, খুব শান্তভঙ্গিতে তুমি তোমার স্যারের স্যুটকেস গুছিয়ে দিলে। রাস্তায় খিদে পেলে খাবার জন্যে একগাদা কী-সব তৈরি করে দিলে। তিনি বিদায় নিলেন খুব সহজভাবেই। ঘর থেকে বেরিয়ে একবারও পিছনে ফিরে তাকালেন না। তুমি মূর্তির মতো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলে।
জরী, তুমি ভুল লোকটিকে বেছে নিয়েছিলে। এইসব লোকের কোনো পিছুটান থাকে না। নিজ স্ত্রী-কন্যার মৃত্যুর পরদিন যে ক্লাস নিতে আসে তাকে কি আর ভালোবাসার শিকলে বাঁধা যায়?
তোমার স্যার চলে যাবার দিন আমি তোমাকে তীব্র অপমান করলাম। বিশ্বাস কর, ইচ্ছে করে করি নি। তোমার স্যার যখন বললেন, আপনার কাছে একটি জিনিস চাইবার আছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কী জিনিস?
আপনার আঁকা একটি ছবি আমি নিতে চাই। হাতজোড় করে প্রার্থনা করছি।
নিশ্চয়ই। আপনার পছন্দমতো ছবি আপনি উঠিয়ে নিন। যে-কোনো ছবি। যেটা আপনার ভালো লাগে।
তিনি ব্যস্ত হয়ে আমার স্টুডিওর দিকে চলে গেলেন। আমি তোমার চোখে চোখ রেখে বললাম, স্যার কোন্ ছবিটি নেবেন জানো তুমি?
না।
স্যার নেবেন তোমার পোট্রেট।
তিনি কিন্তু নিলেন অন্য ছবি। জলরঙে আঁকা এসো নীপবনে। তাকিয়ে দেখি অপমানে তোমার মুখ নীল হয়ে গেছে। তীব্র ঘৃণা নিয়ে তুমি আমার দিকে তাকালে।
সেইসব পুরানো কথা তোমার কি মনে পড়ে? বয়স হলে সবাই তো নস্টালজিক হয়, তুমি হও নি? কুটিল সাপের মতো যে ঘৃণা তোমার বুকে কিলবিল করে উঠেছিল তার জন্যে তোমার কি কখনো কাঁদতে ইচ্ছা হয় না? তুমি কাঁদছ— এই ছবিটি বড় দেখতে ইচ্ছে করে। তোমার স্যার চলে যাবার পর তুমি কী করবে তা কিন্তু আমি জানতাম জরী। তোমার তো এ ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। মিছিমিছি তুমি সারাজীবন লজ্জিত হয়ে রইলে।
আমি তোমাকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যেতে চেয়েছি। তুমি বলেছ, না। তোমাকে কিছুদিন তোমার বাবা-মার কাছে রেখে আসতে চেয়েছি। তুমি কঠিন স্বরে বলেছ, না। কতবার বলেছি, বাইরে থেকে ঘুরে এলে তোমার মন ভালো থাকবে। তুমি শান্তস্বরে বলেছ, আমার মন ভালোই আছে।
আমি জানতাম ঘৃণার দেয়ালে বন্দি হয়ে একজন মানুষ বেশিদিন থাকতে পারে। তোমার সামনে দুটি মাত্র পথ। এক মরে যাওয়া, আর দুই…। কিন্তু মরে যাওয়ার মতো সাহস তোমার ছিল না। কাজেই দ্বিতীয় পথ যা তুমি বেছে নেবে তার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। এও একধরনের খেলা। আমি জানতাম তুমি এবারও পরাজিত হবে। পরাজয়ের মধ্যেই আসবে জয়ের মালা। উৎকণ্ঠায় দিন কাটতে লাগল। কখন আসবে সেই মুহূর্তটি? সেই সময় আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারব তো?
সেই মুহূর্তটির কথা তোমার কি মনে পড়ে কখনো? ঘন হয়ে শীত পড়ছে। শরীর খানিক সুস্থ বোধ হওয়ায় আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছি।
সন্ধ্যা মিলাতেই ঘরে আলো দিয়ে গেল। তারও কিছু পর তুমি এলে চা নিয়ে। চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে গিয়ে চা ছলকে পড়ল মেঝেতে। বিড়বিড় করে তুমি কী যেন বললে। আমি তাকালাম টেবিলের দিকে। বিষের সেই শিশিটি নেই। তুমি অপলকে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। আমি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলাম চায়ের পেয়ালার জন্যে। তুমি জ্ঞান হারিয়ে এলিয়ে পড়লে মেঝেতে। হেরে গেলে জরী।
তোমাকে এরপর খুব সহজেই জয় করা যেত। কিন্তু আমি তা চাই নি, সব ছেড়েছুড়ে চলে এলাম। অল্প কদিন আমরা বাঁচি। তবু এই সময়ে কত সুখ-দুঃখ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। কত গ্লানি, কত আনন্দ আমাদের চারপাশে নেচে বেড়ায়। কত শূন্যতা বুকের ভেতরে হা হা করে।
জরী, এখন গভীর রাত্রি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পোর্টার এসে দরজায় নক করবে। বিমান কোম্পানির মিনিবাস এসে দাঁড়াবে দোরগোড়ায়। আবার যাত্রা শুরু।
আবার হয়তো কোনো এক পেইন্টিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে তোমার কথা মনে পড়বে। আবার এরকম লম্বা চিঠি লিখব। কিন্তু সে সব চিঠি কখনো পাঠাব না তোমাকে। যৌবনে হৃদয়ের যে উত্তাপ তোমাকে স্পর্শ করতে পারে নি, আজ কি আর তা পারবে? কেন আর মিছে চেষ্টা!
গোপন কথা
আজ আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।
আলো তখনো ভালো করে ফোটে নি। এখনো অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। আকাশে ক্ষীণ আলো-আঁধারিতে মন অন্যরকম হয়ে যায়। পৃথিবীর সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
আমি পৃথিবীর সবাইকে ভালোবেসে ফেল্লাম। আমার পাশের চৌকিতে বাকের সাহেব ঘুমিয়ে। অন্ধকারে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। তবু আমি নিশ্চিত জানি তিনি একটি কুৎসিত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছেন। মুখের লালায় তাঁর বালিশ ভিজে গেছে। লুঙি উঠে গেছে কোমরে। তাতে কিছু যায় আসে না। আজ আমার চোখে অসুন্দর কিছু পড়বে না, বাকের সাহেবকেও আমি ভালোবাসব।