কিন্তু দেহবোধের পারে যাইবার শক্তিই আমাদের গুরুর ন্যায় চরিত্রবিকাশের একমাত্র কারণ নহে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী চরমশক্তি বিকাশের জন্য প্রথম আবশ্যক প্রগাঢ় অনুভব শক্তির জাগরণ, কিন্তু পরে উহাকে সম্পূর্ণরূপে সংযত করিতে হইবে। এই ব্যাপারটি এমন এক অনুভূতির রাজ্যের ইঙ্গিত প্রদান করে, যাহা আমাদের অধিকাংশের নিকটেই কল্পনাতীত; তথাপি শিষ্যাবস্থায় স্বামীজীর জীবনের একটি ঘটনা হইতে উহার কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। তাঁহার বয়স তখনও খুব অল্প, এমন সময়ে হঠাৎ তাহার পিতার মৃত্যু পরিবারের মধ্যে দারুণ বিপর্যয় আনয়ন করে। তিনি জ্যেষ্ঠ সন্তান, সুতরাং প্রতিদিন সকলের জন্য চিন্তায় তিনি অধীর হইয়া পড়িতে লাগিলেন। যাহারা তাহার প্রিয়জন, তাহাদের কষ্টে তাহার হৃদয় যেন বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল, এবং সহসা স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌভাগ্যপূর্ণ জীবনের বিপরীত অবস্থা তাহাকে বিমূঢ় করিয়া তুলিল। তাহাদের বিপদের গুরুত্ব দেখিয়াও তিনি যেন বিশ্বাস করিতে পারিলেন না।
অবশেষে মর্মবেদনা সহ্য করিতে না পারিয়া তিনি তাহার গুরুর নিকট একদিন ছুটিয়া গেলেন, এবং তাহাকে তীব্র তিরস্কার করিতে লাগিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ধীরভাবে সমস্ত শ্রবণ করিয়া সস্নেহে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “যা বাবা, ওখানে যা, মা কালীর কাছে প্রার্থনা কর। তুই যা চাইবি, মা তোকে নিশ্চয় তাই দেবেন।”
অতি সাধারণ দৃষ্টিতে এই অঙ্গীকারের মধ্যে কিছুই অসঙ্গত বা অস্বাভাবিক ছিল; কারণ শ্রীরামকৃষ্ণের অনেক ধনী ও মাড়োয়ারী ভক্ত ছিলেন, যাহারা তাহার বাক্য রক্ষা করিবার জন্য সর্বস্ব অর্পণ করিতে পারিতেন। গুরুর উপদেশের শান্তভাব ও দৃঢ়তায় কতকটা আশ্বস্ত হইয়া বালক সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া মন্দিরে গেলেন প্রার্থনা করিবার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ অতীত হইবার পর তিনি প্রত্যাবর্তন করিলেন। ঐ সময়ে যাহারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাহারা বলেন, তাঁহার আকৃতিতে যেন একটা বিহুল ভাব ছিল, এবং কথা বলিতে যেন কষ্টবোধ হইতেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রার্থনা করেছিলি?” শিষ্য উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, করেছি।”
গুরু আবার বলিলেন, “মার কাছে কি চেয়েছিলি?”
নরেন্দ্র উত্তর দিলেন, “পরাভক্তি ও জ্ঞান।”
শ্রীরামকৃষ্ণ কোন মন্তব্য না করিয়া সংক্ষেপে শুধু বলিলেন, ‘আবার যা। কিন্তু কোন পরিবর্তন হইল না। তিনবার তিনি ইচ্ছামতো বর প্রার্থনা করিবার জন্য প্রেরিত হন, তিনবারই প্রত্যাবর্তন করিয়া তিনি একই উত্তর দেন। জগজ্জননীর সমীপে উপস্থিত হইবামাত্র তিনি আর সব বিস্মৃত হইয়া যান; কি প্রয়োজনে সেখানে আসিয়াছেন, সে কথা পর্যন্ত তাহার মনে পড়ে না। আমাদের মধ্যে কেহ কি সেই উচ্চ অবস্থায় কখনও উপনীত হইয়াছেন, যে অবস্থায় আমরা যাহাদের ভালবাসি, তাহাদের কল্যাণ কামনায় তন্ময়ভাবে প্রার্থনা করিতে গিয়া এরূপ আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছে? তাহা হইলে ভেদবৈচিত্র্যময় আপেক্ষিক সাধারণ জগৎ হইতে এই অনুভূতির অনন্তগুণ পার্থক্য হয়তো আমরা কিছুটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছি।
কথা কহিতে কহিতেই স্বামীজীর চিন্তা দেশকালের সীমা অতিক্রম করিত। চিন্তাটা কি অন্তরাত্মা অথবা আদি শক্তির বিকাশের অন্যতম রূপমাত্র? উহাতে যে শক্তি ব্যয়িত হয়, তাহা কি যিনি চিন্তা করেন, তাঁহার কল্যাণের দিক হইতে দেখিলে বৃথা নষ্ট হইল বলিয়া ধরিতে হইবে? প্রথমে কতকগুলি ঘটনার পরিধি, অতঃপর কতকগুলি চিন্তার পরিধি এবং সর্বশেষে সেই পরব্রহ্ম! যদি তাহা হয়, তাহা হইলে মহাপুরুষগণ কর্তৃক নিজ নিজ চিন্তা-সম্পদ অপরের সহিত একত্ৰ সম্ভোগের ন্যায় মহত্তর নিঃস্বার্থ কার্য আর কিছু নাই। তাঁহাদের কল্পনারাজ্যে প্রবেশের অর্থই মোক্ষদ্বার উন্মোচন; কারণ, ঐকালে শিষ্যের মানসে প্রত্যক্ষভাবে একটি বীজ উপ্ত হয়। যাহা মনোজগতে আত্ম-সাক্ষাৎকারে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বিনষ্ট হয় না।
আমাদের গুরুর চিন্তা ছিল কতকগুলি আদর্শের সমষ্টিস্বরূপ, কিন্তু ঐ আদর্শগুলিকে তিনি এমন জ্বলন্ত, জীবন্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন যে, কেহ মনে করিতে পারিত না উহারা বস্তুতন্ত্র নিরপেক্ষ। ব্যক্তি ও জাতি উভয়কেই তিনি সমভাবে তাহাদের আদর্শের মাধ্যমে, তাহাদের নৈতিক উন্নতির মাপকাঠিতে বিচার করিতেন। অনেক সময় আমার মনে হইয়াছে, চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকে দুই বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাগ করা যাইতে পারে—স্বভাব অনুযায়ী তাঁহাদের এক শ্রেণী সব জিনিসকে দুইভাগে ভাগ করিতে চাহেন, অপরশ্রেণী তিনভাগে। স্বামীজীর সর্বদা তিনভাগে ভাগ করার দিকেই প্রবণতা দেখা যাইত। কোন গুণের দুইটি বিপরীত সীমা (যেমন শীত-উষ্ণ, ভাল-মন্দ) তো তিনি স্বীকার করিতেনই, অধিকন্তু উভয়ের মধ্যে যে সংযোগস্থল, তাহাও দেখিতে ভুলিতেন না, যেখানে উভয় দিক সমান হওয়ায়, কোন গুণই নাই, এরূপ বলা যাইতে পারে। ইহা কি প্রতিভারই একটি সর্বজনীন লক্ষণ, অথবা শুধু হিন্দুমনেরই একটি বিশেষত্ব?
কেহই বলিতে পারিত না, কোন্ বস্তুতে তিনি কি দেখিতে পাইবেন, কোন জিনিস তাহার হৃদয়গ্রাহী হইবে। অনেক সময় কথা অপেক্ষা চিন্তার উত্তর তিনি অধিকতর সহজে ও উত্তমরূপে দিতে পারিতেন। কি অদ্ভুত ভাব-তন্ময়তার মধ্যে তিনি অবস্থান করিতেন, তাহা এখানে-সেখানে, এক-আধটু আভাস-ইঙ্গিত হইতেই ধীরে ধীরে বুঝিতে পারা যাইত-সকল কথা ও চিন্তা তাহারই সহচরী মাত্র ছিল। কাশ্মীরে গ্রীষ্মের কয়মাস অতিবাহিত করিবার পর তবে তিনি আমাদের বলেন যে, তিনি সর্বদা জগন্মাতার মূর্তি প্রত্যক্ষ করিতেছেন। মা যেন মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া আমাদের মধ্যে চলাফেরা করিতেছেন। আবার জীবনের শেষ শীত-ঋতুতে তিনি শিষ্য স্বামী স্বরূপানন্দকে বলেন, কয়েকমাস ধরিয়া তিনি দেখিতেছেন যেন দুইখানি হাত তাহার হাত দুইটি ধরিয়া আছে। তীর্থযাত্রাকালে কেহ কেহ দেখিত, তিনি একান্তে মালা জপ করিতেছেন। গাড়িতে তাহার পিছন দিকে উপবিষ্ট থাকাকালীন কেহ কেহ শুনিতে পাইতেন, তিনি কোন একটি মন্ত্র বা স্তোত্র বার বার আবৃত্তি করিতেছেন। তাহার প্রত্যুষে উঠিয়া স্তোত্রাদি আবৃত্তির অর্থ আমরা বুঝিতে পারিলাম, যখন তিনি একদিন জনৈক কর্মীকে সংসার-সমরাঙ্গণে প্রেরণকালে বলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস প্রত্যহ সকালে অন্য কোন কাজ করবার আগে নিজের ঘরে দুঘণ্টা ধরে ‘সচ্চিদানন্দ, ‘শিবোহ প্রভৃতি শব্দ উচ্চারণ করতে করতে পায়চারি করে বেড়াতেন।” সর্বসমক্ষে এই ইঙ্গিত প্রদান ব্যতীত আমরা আর কিছু শুনিতে পাই নাই।