যে কঠোর সাধনার দ্বারা এই আত্মসংযমশক্তি বিকাশলাভ করিয়াছে, তাহা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ নহে! হয়তো কত ঘণ্টা পূজা ও ধ্যানে অতিবাহিত হইয়াছে, কতক্ষণ ধরিয়া একদৃষ্টে তাকাইয়া থাকিতে হইয়াছে এবং দীর্ঘকাল আহার ও নিদ্রা পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে! শেষোক্ত ব্যাপারে বস্তুতঃ এক সময়ে পচিশ দিন ধরিয়া তিনি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র আধঘণ্টা নিদ্রা যাইতেন। আবার এই অর্ধঘণ্টা নিদ্রা হইতেও তিনি নিজেই জাগিয়া উঠিতেন। সম্ভবতঃ ইহার পর নিদ্রা আর কখনও তাহাকে পীড়াপীড়ি করিতে বা বহুক্ষণ ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। তাহার ‘যোগীর চক্ষু ছিল। বাল্যকালে যখন তিনি গঙ্গাবক্ষে শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরায় উঠিয়া তাহাকে প্রশ্ন করেন, “মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?”—তখন তিনি তাহাকে একথা বলেন। যোগীর চক্ষু কদাপি সম্পূর্ণরূপে মুদ্রিত হয় না, এবং সূর্যোদয় হইবামাত্র একেবারে উন্মীলিত হইয়া যায়, ইহাই প্রবাদ। পাশ্চাত্যে যাহারা তাহার সহিত একগৃহে অবস্থান করিতেন, তাহারা শুনিতে পাইতেন, রাত্রিশেষে স্নান করিবার সময় তিনি পরব্রহ্ম অথবা ঐ জাতীয় কোন নাম সুর করিয়া আবৃত্তি করিতেছেন। তাহাকে কঠোরতা অভ্যাসকরিতে কখনও দেখা যাইত না, কিন্তু তাহার সমগ্র জীবন এরূপ প্রগাঢ় তন্ময়তাপূর্ণ ছিল যে, অপর কাহারও নিকট উহাই কঠোর তপস্যা বলিয়া প্রতীত হইত। আমেরিকার ন্যায় রেলরাস্তা, ট্রাম প্রভৃতি যানবহুল ও জটিল নিমন্ত্রণ-তালিকার দেশে প্রথমদিকে তাহাকে ধ্যানে তন্ময় হইবার প্রবণতা কিরূপ কষ্টে দমন করিতে হইত, তাহার আমেরিকাবাসী বন্ধুগণ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তাহাকে স্বগৃহে আমন্ত্রণকারী জনৈক ভারতবাসী বলেন, “ধ্যান করতে বসলে দশ মিনিট যেতে না যেতেই তিনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তেন, যদিও তার শরীর মশায় ছেয়ে যেত।” এই অভ্যাস তাঁহাকে দমন করিতে হইত। প্রথম দিকে, লোকে হয়তো রাস্তার অপর প্রান্তে অপেক্ষারত, এদিকে তিনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন বাহ্যজ্ঞানশূন্য। ইহাতে তিনি বিশেষ লজ্জিত হইতেন। একবার নিউ ইয়র্কে একটি ক্লাসে তিনি ধ্যান শিক্ষা দিতেছেন, শেষে দেখা গেল কিছুতেই তাহার বাহ্যসংজ্ঞা ফিরিয়া আসিতেছে না; অতঃপর ছাত্রগণ একে একে নিঃশব্দে প্রস্থান করিল। পরে এই ব্যাপারটি শুনিয়া তিনি অতীব মর্মাহত হন এবং পুনরায় কখনও ক্লাসে ধ্যান শিক্ষা দিতে সাহস করেন নাই। নিজেব ঘরে দুই-একজনকে সঙ্গে লইয়া ধ্যান করিবার সময় তাহাদের কোন একটি কথা বলিয়া দিতেন, যাহা পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিলে তাহার বাহ্যচৈতন্য ফিরিয়া আসিত।
কিন্তু ধ্যানের সময়ের কথা একেবারে ছাড়িয়া দিলেও তিনি প্রায় সর্বদাই চিন্তায় তন্ময় হইয়া যাইতেন। দশজনে মিলিয়া গল্প-গুজব, হাস্য-পরিহাস চলিতেছে, এমন সময় দেখা গেল, তাহার নয়নদ্বয় স্থির হইয়া গিয়াছে, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ক্রমেই রুদ্ধ হইয়া অবশেষে একেবারে স্থির; তারপর ধীরে ধীরে পুনরায় পূর্বাবস্থাপ্রাপ্তি। তাহার বন্ধুগণ এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন এবং সেইমতো ব্যবস্থা করিতেন। দেখা করিবার উদ্দেশ্যে কাহারও বাড়িতে প্রবেশ করিয়া যদি তিনি কথা কহিতে ভুলিয়া যাইতেন, অথবা যদি তাহাকে কোন ঘরে নিঃশব্দে বসিয়া থাকিতে দেখা যাইত, তাহা হইলে কেহ তাহাকে বিরক্ত করিত না, যদিও কখন কখনও তিনি নিজেই উঠিয়া মৌনভঙ্গ না করিয়াই আগন্তুককে সাহায্য করিতেন। এইরূপে তাহার মন অন্তরেই সমাহিত থাকিত, বাহিরের বস্তু অন্বেষণ করিত না। তাহার চিন্তার উচ্চতা ও পরিব্যাপ্তি সম্বন্ধে তাহার কথাবার্তাই ছিল আমাদের নিকট ইঙ্গিত। তাহার প্রসঙ্গ ছিল সর্বদা নিগুণ তত্ত্ব সম্পর্কে। যাহাকে লোকে সচরাচর ধর্মপ্রসঙ্গ বলিয়া অভিহিত করে, উহা ঠিক তদনুরূপ ছিল না–তাহার গুরুদেব সম্পর্কেও ঐকথা প্রযোজ্য। অনেক সময়েই প্রসঙ্গের বিষয় ছিল ঐহিক। কিন্তু উহার পরিধি ছিল অতি বিস্তৃত। যাহার মধ্যে কদাপি কোন নীচতা, সঙ্কীর্ণতা, বা ক্ষুদ্রতা থাকিত না; কোথাও সহানুভূতি সঙ্কোচপ্রাপ্ত হইত না। এমনকি, তাঁহার বিরুদ্ধ সমালোচনাও মনে হইত—কেবল সংজ্ঞানির্দেশক ও বিশ্লেষণমূলক, কোনপ্রকার বিদ্বেষ বা ক্রোধ উহাতে থাকিত না। নিজের সম্বন্ধে তিনি একদিন বলেন, “আমি একজন অবতারের পর্যন্ত বিরুদ্ধ সমালোচনা করিতে পারি, অথচ তার দ্বারা তার প্রতি আমার ভালবাসা বিন্দুমাত্র হ্রাস পাবে না। কিন্তু আমি ভাল করেই জানি, অধিকাংশ লোকই তা পারবে না, তাদের পক্ষে নিজ নিজ ভক্তিটুকু বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে নিরাপদ।” তাহার বিশ্লেষণ শ্রবণে শ্রোতার মনেও আলোচ্য বিষয়ের প্রতি কোন বিরাগ বা ঘৃণার ভাব অবশিষ্ট থাকিত না।
জগতের প্রতি এই উদার ও মধুর দৃষ্টিভঙ্গি তাহার গুরুভক্তির উপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ছিল। একবার তিনি বলেন, “আমার ভক্তি কুকুরের প্রভুভক্তির মতো। আমি কারণ খুঁজি না। পদানুসরণ করেই আমি সন্তুষ্ট।” শ্রীরামকৃষ্ণেরও নিজ গুরু তোতাপুরীর প্রতি অনুরূপ মনোভাব ছিল। এই আচার্যশ্রেষ্ঠ একদিন আম্বালার নিকটবর্তী কৈথাল নামক স্থানে নিজ শিষ্যগণকে এই বলিয়া চলিয়া আসেন, “আমাকে বাংলাদেশে যেতে হবে। আমি প্রাণে প্রাণে অনুভব করছি যে, সেখানে একজন মুমুক্ষুর এখন আমার নিকট সাহায্যের দরকার।” দক্ষিণেশ্বরে তাহার কার্য শেষ হইলে তিনি পুনরায় নিজ শিষ্যগণের নিকট প্রত্যাবর্তন করেন। উত্তর পশ্চিম প্রদেশে তাহার সমাধিস্থান অদ্যাপি লোকের শ্রদ্ধা-ভক্তি আকর্ষণ করিতেছে। কিন্তু যাহাকে তিনি দীক্ষিত করিয়াছিলেন, তিনি তাহার প্রতি এরূপশ্রদ্ধা-ভক্তি পোষণ করিতেন যে, কদাপি তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করিতেন না। “ন্যাংটা আমাকে একথা বলত”—এইরূপেই তিনি তাঁহার সম্বন্ধে উল্লেখ করিতেন। জগতের প্রাত পূর্ণ প্রেম এবং মানবের উপর পূর্ণ বিশ্বাস কেবল সেই হৃদয়বান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যিনি কাহারও মধ্যে নিজ আদর্শ সম্যকভাবে রূপায়িত হইতে দেখিয়াছেন।