ভারতীয় আদর্শ ইহার বিপরীত। তিনিই ভারতের আদর্শ পুরুষ, মনের প্রবৃত্তিসমূহ যিনি এমন সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করিয়াছেন যে, যে-কোন মুহূর্তে চিন্তাসমুদ্রে অবগাহন করিয়া ইচ্ছামত সেখানে অবস্থান করিতে পারেন; যিনি দুর্দম তন্ময়তাস্রোতে সম্পূর্ণরূপে ভাসিয়া যাইতে পারেন—সহসা ঐ ভাব ভঙ্গ হইয়া অপ্রত্যাশিতভাবে পুনরায় ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে না। অবশ্য শিক্ষার গভীরতা ও অনুভূতির গাঢ়তা এই শক্তিলাভের সহায়ক হয়। কিন্তু উহা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিবার একমাত্র উপায় হইল কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ—এত কঠোর যে, সাধক যেন ইচ্ছামাত্র চিন্তারও বাহিরে চলিয়া যাইতে পারেন। যিনি নিজ মনকে এরূপ একাগ্র করিতে পারেন যে, ইচ্ছামাত্র উহাকে সম্পূর্ণ নিরোধ করিতে সমর্থ, তাঁহার নিকট মন আজ্ঞাবাহক ভৃত্য, অথবা দ্রুতগামী অশ্বের ন্যায় হইয়া যায় এবং শরীরও মনের অনুগত প্রজারূপে পরিণত হয়। এরূপ ক্ষমতা লাভ না করা পর্যন্ত সিদ্ধি—সম্পূর্ণ অবিচলিত আত্মসংযম আসে না। একপুরুষে এরূপ কয়জন জন্মগ্রহণ করেন, যাহারা এইরূপ উচ্চাধিকারী হইতে পারেন? এইরূপ মহাপুরুষের কার্য ও কথায় এমন একটা জ্যোতি, এমন একটা দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, যাহা বুঝিতে ভুল হয় না। বাইবেলের ভাষায়, “তাহারা এমনভাবে কথা বলেন, যেন তাহাদের ‘চাপরাস’ আছে, তাহারা কেবল পুঁথিপড়া পণ্ডিতমাত্র নন।”
একথা নিঃসন্দেহ যে, বালক নরেন্দ্রকে প্রথম দর্শনেই শ্রীরামকৃষ্ণ ‘আজন্ম ব্রহ্মজ্ঞানী’ বলিয়া বুঝিতে পারেন, এবং সুদক্ষ ইঞ্জিনীয়ার কর্তৃক কোন প্রবাহের বেগ নিরূপণের ন্যায় ইতিমধ্যেই বালক কতদূর মানসিক উচ্চাবস্থা লাভ করিয়াছে, তাহাও তিনি ধরিতে পারেন। আগ্রহের সহিত তিনি জিজ্ঞাসা করেন,”হাগা, তুমি কি ঘুমুবার আগে একটা জ্যোতি দেখতে পাও?” সবিস্ময়ে বালক উত্তর দিলেন, “কেন, সকলেই কি দেখে না?” পরবর্তী কালে প্রায়ই তিনি এই প্রশ্নটির উল্লেখ করিতেন এবং প্রসঙ্গক্রমে তিনি যে জ্যোতি দেখিতেন, তাহার বর্ণনা দিতেন। কখন কখনও ঐ জ্যোতি একটি গোলকের মতো হইত, এবং একটি বালক পা দিয়া উহা তাহার দিকে ছুঁড়িয়া দিত। ক্রমে উহা নিকটবর্তী হইলে, তিনি উহার সহিত এক হইয়া যাইতেন এবং সমস্ত জগৎ বিস্মৃত হইতেন। কখনও উহা অগ্নিপুঞ্জের মতো দেখাইত, এবং তিনি উহার মধ্যে প্রবেশ করিতেন। বিস্মিতচিত্তে আমরা ভাবি, যে নিদ্রার প্রারম্ভ এইরূপ তাহা কি আদৌ সেই নিদ্রা—যাহা আমরা সচরাচর নিদ্রা বলিতে বুঝিয়া থাকি? সে যাহা হউক, যে-সকল ব্যক্তি স্বামী বিবেকানন্দের সমবয়স্ক যুবক ছিলেন, তাহারা বলেন, বিবেকানন্দ নিদ্রিত হইলে তাহাদের গুরুদেব তাহার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস লক্ষ্য করিয়া অপর সকলকে বলিতেন, “উহাকে নিদ্রিত বলিয়া মনে হইতেছে মাত্র এবং এখন ধ্যানাবস্থার কোন্ স্তরে তিনি উপনীত হইয়াছেন, তাহা সকলকে বুঝাইয়া দিতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কাশীপুর উদ্যানে পীড়িত হইয়া অবস্থান করিতেছেন, সেই সময় একদিন স্বামীজী ঐরূপ কয়েকঘণ্টাকাল যেন নিদ্ৰাই যাইতেছিলেন বলিয়া সমীপন্থ ব্যক্তির মনে হয়। প্রায় মধ্যরাত্রে তিনি সহসা চিৎকার করিয়া ওঠেন, “আমার শরীর কোথায়?” তাহার সঙ্গী–বর্তমানে গোপালদাদা নামে পরিচিত বৃদ্ধ সাধু দৌড়িয়া তাহার নিকটে গিয়া সজোরে সমস্ত অঙ্গ ডলিয়া দিয়া মস্তকের নিম্ন হইতে শরীরের লুপ্ত অনুভূতি ফিরাইয়া আনিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন। যখন তাহার সব চেষ্টা ব্যর্থ হইল এবং নরেন্দ্র তখনও বিশেষ কষ্ট ও আতঙ্ক অনুভব করিতেছেন, তখন গোপালদাদা দৌড়িয়া শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট গিয়া শিষ্যের অবস্থা তাহাকে জানাইলেন। তিনি শুনিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, “থাক ঐরকম! কিছুক্ষণ ঐভাবে থাকলে ওর কোন ক্ষতি হবে না। ঐ অবস্থা লাভ করবার জন্য সে আমাকে অনেক জ্বালাতন করেছে।” পরে তিনি গোপালদাদা ও অন্যান্য সকলকে বলেন, নরেন্দ্রের নির্বিকল্প সমাধিলাভ হইয়াছে; এখন তাহাকে কাজ লইয়া থাকিতে হইবে। স্বামীজী স্বয়ং পরে এই অবস্থা সম্বন্ধে তাহার গুরুভ্রাতা স্বামী সারদানন্দের নিকট এইরূপবর্ণনা করেনঃ “মাথার ভেতরে যেন একটা আলো দেখতে পাচ্ছিলাম; সেটা এত উজ্জ্বল যে, আমি ধরেই নিয়েছিলুম আমার মাথার পিছনে কেউ একটা উজ্জ্বল আলো রেখে গিয়ে থাকবে।” অতঃপর ইন্দ্রিয়ানুভূতির সকল বন্ধন ছিন্ন হওয়ায় তিনি সেই রাজ্যে উত্তরণ করেন, যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ’, একথা আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারি।
বুঝিতে হইবে যে, মনকে একাগ্র করিবার জন্য সর্বপ্রথম আমাদের দেহকে ভুলিতে পারা চাই। এই উদ্দেশ্যেই লোকে তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের অভ্যাস করিয়া থাকে। কিছুকাল কঠোর তপস্যায় কাটাইবার চিন্তা আজীবন স্বামীজীর নিকট আনন্দদায়ক ছিল। নির্ভীকভাবে বিজয়ীর ন্যায় সংসারে বিচরণ করিয়া বেড়াইলেও প্রায়ই তিনি তপস্যা-প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতেন। সুদক্ষ অশ্বারোহী যেমন অশ্বের লাগাম ধরিয়া দেখে, অথবা প্রসিদ্ধ সঙ্গীত-বিশারদ যেমন বাদ্যযন্ত্রের পর্দার উপর অঙ্গুলি সঞ্চালন করিয়া দেখে, তিনিও সেইরূপ বার বার দেখিতে ভালবাসিতেন, শরীরটা ইচ্ছাশক্তির সম্পূর্ণ বশে চলে কি-না—যন্ত্রের উপর এখনও তাঁহার পূর্ববৎদখল আছে কি-না, নূতন করিয়া দেখিতে তিনি প্রীতি অনুভব করিতেন। জীবনের অন্তিমকালে তিনি বলেন, “দেখছি, আমি এখনো যা ইচ্ছা করতে পারি।” ঐ সময় কলকাতার গ্রীষ্মকালের কয়মাস তিনি জলপান না করিয়া থাকিতে স্বীকৃত হন। অবশ্য মুখ ধুইবার নিষেধ ছিল না। সেই সময় তিনি দেখেন যে, একবিন্দু জল প্রবেশ করিতে গেলেও তাহার গলার পেশীসমূহ আপনা হইতে বন্ধ হইয়া যাইত, সুতরাং ইচ্ছা করিলেও তিনি জল পান করিতে পারিতেন না। কোন ব্রত উপলক্ষে যখন তিনি উপবাস করিতেন, তখন তাহার নিকট অবস্থানকালে অপরেরও খাদ্যসামগ্রী অনাবশ্যক বোধ হইত, এবং চেষ্টা করিয়াও ঐ বিষয়ে রুচি হইত না। একটি ঘটনার কথা আমি এইরূপ শুনিয়াছি যে, তিনি বসিয়াছিলেন, এবং তাহার চারিপার্শ্বে উপবিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি তর্ক-বিতর্ক করিতেছিল; মনে হইতেছিল, ঐ সকল কথা তিনি শুনিতেছেন না। হঠাৎ তাহার হস্তস্থিত একটি শূন্য কাচের গ্লাস মাটিতে নিক্ষিপ্ত হইয়া চূর্ণ হইয়া গেল—ঐ তর্কে তাহার যে কষ্টবোধ হইতেছিল, ঐটুকুই তাহার নিদর্শন।