চাঁদের উপর দিয়া মেঘ চলিয়া যায়; এবং তাহাতেই ভ্রম হয় যেন চাঁদ চলিয়া যাইতেছে। সেইরূপ প্রকৃতি, দেহ ও জড় পদার্থ সকলেই গতিশীল, তাহাতেই ভ্রম হইতেছে যেন আত্মা গতিশীল। সুতরাং অবশেষে আমরা দেখিতে পাই যে, যে সহজাত জ্ঞান (অথবা দৈব প্রেরণা?) বশে সর্বজাতির উচ্চ-নীচ সবরকম ব্যক্তি মৃতব্যক্তিগণের সান্নিধ্য—যেন তাহারা নিকটে আসিয়াছে এইরূপ অনুভব করে, যুক্তির দৃষ্টিতেও উহা সত্য।
“প্রত্যেক জীবাত্মাই এক একটি নক্ষত্রস্বরূপ, আর এই সব নক্ষত্ররাজি ঈশ্বররূপী সেই অনন্ত নীলিমায়, সেই অনাদি অনন্ত আকাশে বিন্যস্ত। সেখানেই প্রত্যেক জীবাত্মার মূল, যথার্থ সত্তা এবং প্রকৃত ব্যক্তিত্ব নিহিত। কতকগুলি জীবাত্মারূপ তারকা, যাহারা আমাদের চক্রবালের বহির্ভূত হইয়া গিয়াছে তাহাদের অন্বেষণেই ধর্মের সূত্রপাত, এবং তাহাদের সকলকে সেই ঈশ্বরে এবং আমাদেরও সেই একই স্থলে অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যে দেখিতে পাওয়ার মধ্যেই ধর্মের সমাপ্তি। সুতরাং সমগ্র রহস্য এই যে, আপনার পিতা পরিহিত জীর্ণ বস্ত্রখানি পরিত্যাগ করিয়াছেন, এবং যেখানে তিনি অনাদি অনন্তকাল ধরিয়া অবস্থিত সেখানেই রহিয়াছেন। এই জগতে বা অপর কোন জগতে তিনি কি আর একখানি অনুরূপ বস্ত্র সৃষ্টি করিবেন? আমার আন্তরিক প্রার্থনা যেন তাহাকে আর তাহানা করিতে হয়—যতক্ষণ না পূর্ণ জ্ঞানের সহিত তিনি উহা পারেন। ভগবৎসমীপে প্রার্থনা, কেহ যেন নিজ কৃতকর্মের অলক্ষ্য শক্তির দ্বারা বলপূর্বক কোথাও নীত না হয়। প্রার্থনা করি, সকলেই যেন মুক্ত হইয়া যাইতে পারে, অর্থাৎ জানিতে পারে যে, তাহারা মুক্তই আছে। আর যদি পুনরায় তাহাদের স্বপ্ন দেখিতে হয়, তবে আসুন আমরা সকলে প্রার্থনা করি, যেন তাহাদের স্বপ্ন শান্তি ও আনন্দপূর্ণ হয়।”
———–
১ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউবোপের মৃত্যু সম্পৰ্কীয় ধারণা কতকটা এইরূপ বলা যাইতে পারে। একজন মনীষী বলিয়াছেন, “আত্মা কি বীণাব তাকে উৎপন্ন ঝঙ্কারের মতো, অথবা বৈঠা ধরিয়া নৌকায় উপবিষ্ট মাঝির মতো?” জড়পদার্থের সূক্ষ্মাবস্থাপ্রাপ্তি সম্বন্ধে অধুনা প্রচলিত কথাবার্তা বৈজ্ঞানিকদের পক্ষেও একথা বলা সহজ করিয়া দিয়াছে যে, “একটা পরিণাম অবস্থা (cycle) কল্পনা করা—উহাকে মন’ বলিতে পার—যাহাতে জড়পদার্থ একপ্রকার নাই বলিলেই চলে। কিন্তু তাহা হইলেও পাশ্চাত্য দেশমূহের জন্য বিশেষভাবে দেখানো প্রয়োজন যে, কিরূপে ব্যষ্টি শরীর-মন এই সমষ্টি জড়পদার্থ ও মনকে আশ্রয় করে যাহাতে উভয়ই একাকার হইয়া যায়। এখানে একথা বলা অভিপ্রায় নহে যে, সকল ধর্মে নীতিসম্মত আচরণ শেষ পর্যন্ত আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে; এখানে শুধু অজ্ঞেয়বাদী ও হিন্দুধর্মের মধ্যে যে বৈপরীত্য তাহাই প্রদর্শন করা হইতেছে। অজ্ঞেযবাদী নিচ হইতে উপরে উঠিয়া আধ্যাত্মিক জীবন গঠন করিতে চাই; হিন্দুধর্মমতে বিচার করিয়া দেখিলে আমাদের দেহবুদ্ধি আধ্যাত্মিক জীবনের স্কুল বিকাশ ও আবরণ মাত্র। এই অধ্যাত্ম জীবনের অদম্য আকাঙক্ষা আত্মরক্ষার জন্য নহে, আত্মোৎসর্গই উহার উদ্দেশ্য। আধুনিকগণ বিচার দ্বারা সৃষ্ট পদার্থ হইতে অদৃশ্যে পেীছাইতে চান, বিশেষ হইতে সামান্যে-উপনীত হন, হিন্দুগণ সাধারণ বা সর্বজনীন হইতে বিশেষের বিচার করেন এবং এই অভিমত পোষণ করেন যে, মৃত্যুর পর কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা জানিবার উহাই প্রকৃষ্ট বিচার পন্থা, কারণ, প্রকৃতপক্ষে আমরা একমাত্র আত্মার জীবন সম্বন্ধেই অবগত আছি।
২ স্বামীজীর প্রশ্নোত্তর আকারে একখানি পুস্তক লিখিবার সঙ্কল্পকার্যে পবিণত হইতে পারে নাই। কিন্তু ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি লণ্ডনে যে-সকল বক্তৃতা প্রদান করেন, তাহা পাঠে সহজেই বুঝা যায় যে, এ-স্থলে তিনি যে-সব ভাবের ইঙ্গিত দিয়াছেন, ঐ সম্বন্ধে তখনও চিন্তা করিতেছেন। ব্রহ্ম’ ও ‘মায়া; ‘বহির্জগৎ’ এবং তাহার আমেরিকায় প্রদত্ত মানবের প্রকৃত স্বরূপ ও আভাসিক সত্তা এবং ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’বক্তৃতাগুলি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।
২৫. সমাধি
যে ব্যক্তি একখানি সরু তক্তার উপর দিয়া কোন গভীর গহ্বর (খাদ) পার হয়, যে কোন মুহূর্তে হঠাৎ তাহার সমস্ত অভ্যস্ত সংস্কার ও অনুভূতির কথা মনে উদিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই অত্যুচ্চ স্থান হইতে পড়িয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে। আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার বাহিরে যে মনোরাজ্য অবস্থিত তাহাতে মধ্যে মধ্যে মানবের প্রবেশলাভ সম্পর্কে শাস্ত্রে আমরা যে-সকল গল্প লিপিবদ্ধ দেখিতে পাই, তাহারাও অনেকটা এই রকমের। সমুদ্রের উপর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে যে মুহূর্তে পিটারের মনে পড়িল তিনি কোথায় রহিয়াছেন, অমনি তিনি ডুবিয়া যাইতে আরম্ভ করিলেন। পর্বতপার্শ্বে নিদ্রিত কয়েকজন ক্লান্ত ব্যক্তি জাগ্রত হইবার পর দেখিলেন, তাহাদের আচার্যদেব সম্পূর্ণ নূতন আকৃতিতে পরিবর্তিত হইয়া সম্মুখে বিদ্যমান। কিন্তু আবার তাঁহারা এই পার্থিব জগতে নামিয়া আসিলেন; আর ইতিমধ্যেই সেই অপূর্ব দর্শন অন্তর্হিত হইয়া স্মৃতিমাত্রে পর্যবসিত হইয়াছে। রাত্রিকালে ক্ষেতের মধ্যে বসিয়া মেষপাল পাহারা দিতে দিতে মেষপালকগণ অস্ফুটস্বরে উচ্চ ধর্ম-প্রসঙ্গ করিতেছে, সহসা তাহারা দেবদূতগণের আবির্ভাব দেখিতে পাইল। কিন্তু সেই মুহূর্ত কয়টি চলিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানে এবং কালে মনের সেই উচ্চ অবস্থাও চলিয়া গেল; আর একি! সেই দেবদূতগণও আকাশ হইতে অন্তর্হিত হইলেন! তাহাদের শ্রোতৃবৃন্দ নিকটবর্তী গ্রামে যে অসাধারণ ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহা দেখিবার জন্য সাধারণ লোকের ন্যায় পদব্রজে যাইতে বাধ্য হইল।