“এখন যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তি কেবল নিজের মধ্যেই জগৎ উপলব্ধি করিতে পারে, সেই হেতু ঐ জগৎ তাহার বন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্ট এবং তাহার মুক্তিতেই উহার লয়—যদিও অন্যান্য বদ্ধ ব্যক্তিগণের পক্ষে উহা বর্তমান থাকে। নামরূপ লইয়াই জগৎ। সমুদ্রের একটি তরঙ্গ ততক্ষণই তরঙ্গ, যতক্ষণ উহা নামরূপের দ্বারা পরিচয়। তরঙ্গ অবস্থা চলিয়া গেলে উহা সমুদ্র হইয়া যায়, কিন্তু তখন ঐ নামরূপ তৎক্ষণাৎ চিরদিনের মতো অন্তর্হিত হইয়া যায়। অতএব যে জল নামরূপ দ্বারা পরিচ্ছিন্ন হইয়া তরঙ্গাকারে পরিণত হইয়াছিল, সেই জল ব্যতীত তরঙ্গের ঐ নামরূপের অস্তিত্ব থাকিতে পারে না, কিন্তু নামরূপ তরঙ্গ নয়। তরঙ্গ জলে মিলিয়া যাইলেই ঐ নামরূপ চিরকালের জন্য বিনাশপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু অন্যান্য তরঙ্গের সম্বন্ধে অপরাপর নামরূপ তখনও বিদ্যমান থাকে। এই নামরূপই মায়া, আর ঐ জল ব্ৰহ্ম। তরঙ্গ সর্বদা জল ব্যতীত অন্য কিছুই ছিল না, তথাপি যতক্ষণ উহা তরঙ্গপদবাচ্য ছিল, ততক্ষণ উহার নামরূপও ছিল। আবার ঐ নাম রূপ এক মুহূর্তের জন্যও তরঙ্গ হইতে পৃথক থাকিতে পারে না যদিও জলাকারে ঐ তরঙ্গ অনন্তকাল নামরূপ হইতে পৃথক থাকিতে পারে। কিন্তু যেহেতু নামরূপকেকোন পদার্থ হইতে পৃথক করা যায় না, সেই হেতু নামরূপ সৎ পদার্থ এ কথা বলা চলে না—অর্থাৎ তাহাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। তথাপি তাহারা শূন্য নহে—ইহাই মায়া।
“এই সব আমি সাবধানে ও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিতে চাই, কিন্তু আপনি এক নজরেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমি ঠিক পথে চলিয়াছি। এই কাজের জন্য আমাকে আরও বেশি করিয়া শারীরবিজ্ঞান পড়িতে হইবে, উচ্চতর ও নিম্নতর কেন্দ্রগুলির পরস্পরের মধ্যে কি সম্বন্ধ তাহা নির্ণয় করিতে হইবে। মনস্তত্বের মন, চিত্ত, বুদ্ধি ইত্যাদি কাহার কতটুকু ক্রিয়া প্রভৃতি সব ঠিক করিয়া লইতে হইবে। কিন্তু এখন আমি স্পষ্ট আলো দেখিতে পাইতেছি, তাহার মধ্যে আর কোন ভোজবাজি বা অস্পষ্টতা নাই।”
আবার এই পত্রে, অন্যান্য বহুস্থলের ন্যায়, আমরা স্বামীজীর প্রতিভার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও সংগঠন করিবার শক্তির পরিচয় পাই। আচার্য শঙ্কর যে উচ্চাদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, তাহার কোনরূপ নড়চড় হইবে না। “আত্মা আসেনও না, যানও না”, এই বাক্য চিরকালের জন্য সকল সত্যের উপর প্রাধান্য লাভ করিবে। কিন্তু যাহারা অপর প্রান্ত হইতে কার্য আরম্ভ করিয়াছেন, তাহাদের পরিশ্রমও বৃথা যাইবে না, অদ্বৈতবাদীর দার্শনিক সূক্ষ্মদৃষ্টি এবং দ্বৈতবাদীর মনের পূর্বাপর বিভিন্ন অবস্থার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ—উভয়ই পরস্পরের এবং নূতন ধর্মব্যাখ্যার পক্ষে আবশ্যক।(২)
মৃত্যু জিনিসটা অবশ্য বাহির হইতে দেখিলেই যথার্থ অনুধাবন করা যায়। ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের মধ্যে এই চিরন্তন নিয়তির মহান সত্যগুলি আমরা তত স্পষ্টরূপে দেখিতে পাই না; গভীর বন্ধুত্ব ও ভালবাসার প্রভাবে যখন অপরের দুঃখে আমাদের সহানুভূতি বিচিত্রভাবে উদ্বেলিত হয়, তখনই উহাদের স্পষ্ট উপলব্ধি হয়। যে সান্ত্বনার উপর আমরা নিজেদের বেলায় নির্ভর করিতে সাহসী হই না, তাহা অপরের জন্য অন্বেষণ করিতে গেলে মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট, দৃঢ় বিশ্বাসরূপে প্রতিভাত হয়। স্বামীজীও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না, এবং সম্ভবতঃ আমাদের মধ্যে অনেকে এ সম্বন্ধে তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ উক্তি একখানি পত্রের মধ্যে দেখিতে পাইবেন। পত্রখানি যে আমেরিকাবাসিনী মহিলাকে তিনি ধীরামাতা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন, তাঁহার পিতৃবিয়োগ উপলক্ষে লিখিত। এই পত্রে তাহার বিশ্বাসের সারবত্তা গভীর আত্মীয়তা ও সহানুভূতির দ্বারা সঞ্জীবিত দেখিতে পাই, এবং মৃত্যুর পর আমাদের প্রিয়জনের গতি সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।
১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ব্রুকলীন হইতে তিনি এই শোকসন্তপ্তা মহিলাকে লেখেন, “আপনার পিতা যে তাহার জীর্ণ শরীর ত্যাগ করিবেন, তাহার কতকটা আভাস আমি পূর্বেই পাই, আর যখন কোন ভাবী অপ্রিয় মায়ার তরঙ্গ কাহাকেও আঘাত করিতে উদ্যত দেখি, তখন তাহাকে পত্র লেখা আমার ___ । কিন্তু এইগুলিই জীবনের মহাসন্ধিক্ষণ, এবং আমি জানি, আপনি _____ বিচলিত আছেন। সমুদ্রের উপরিভাগ পর্যায়ক্রমে উঠে ও নামে বটে, কিন্তু সেই সাক্ষিস্বরূপ, জ্যোতির তনয়ের নিকট প্রত্যেক পতন সমুদ্রের গভীরতা এবং তাহার তলদেশস্থ অসংখ্য মণি-মুক্তা ও প্রবালস্তরকে অধিকতররূপে প্রকাশ করিয়া থাকে। আসা-যাওয়া সম্পূর্ণ ভ্ৰমমাত্র। আত্মা কখনও আসেনও না, যানও না। যখন সমুদয় দেশই আত্মার মধ্যে অবস্থিত, তখন সে স্থানই বা কোথায়, যেখানে আত্মা যাইতে পারেন? যখন সমগ্র কালই আত্মাতে অবস্থিত, তখন সে সময়ই বা কোথায় যখন, আত্মা শরীরাভ্যন্তরে প্রবেশ এবং তাহা পরিত্যাগ করিবেন?
“পৃথিবী ঘুরিতেছে, তাহাতেই ভ্রম হয়, সূর্য আকাশ পরিক্রম করিতেছে; সূর্য কিন্তু স্থির আছেন। সেইরূপ প্রকৃতি বা মায়া অথবা স্বভাব গতিশীল, পরিবর্তনশীল—আবরণের পর আবরণ উন্মোচন করিতেছেন, এই মহান গ্রহের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাইতেছেন, আর সাক্ষিস্বরূপ আত্মা অবিচলিত, অপরিবর্তিত থাকিয়া জ্ঞানামৃত পানে বিভোর। যত জীবাত্মা পূর্বে ছিল, বর্তমানে আছে, অথবা ভবিষ্যতে থাকিবে, সকলেই এখনই রহিয়াছে, আর জড় জগতের একটি উপমা গ্রহণ করিলে বলা যায়, তাহারা সকলেই এক জ্যামিতিক বিন্দুতে অবস্থিত। যেহেতু আত্মাতে দেশবোধ নাই, অতএব যাহারা আমাদের ছিলেন, রহিয়াছেন এবং ভবিষ্যতে আমাদের হইবেন, তাহারা সকলেই সর্বদা আমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, সর্বদা সঙ্গে ছিলেন এবং পরেও সর্বদা আমাদের সঙ্গে থাকিবেন। আমরা তাঁহাদের ভিতর রহিয়াছি, তাহারাও আমাদের ভিতর অবস্থিত।

“এই কোষগুলির কথা ধর। যদিও তাহারা প্রত্যেকটি পৃথক, তথাপি সকলেই ক ও খ-তে সম্মিলিতভাবে যুক্ত। এইখানে তাহারা এক। প্রত্যেকে এক একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি (বস্তু), তথাপি সকলেই ঐ ক, খ অক্ষরেখায় এক। কেহই ঐ অক্ষরেখা হইতে সরিয়া যাইতে পারে না, এবং উহাদের কোনটি অক্ষরেখা হইতে যতই পৃথক্ হইয়া যাইবার চেষ্টা করুক, তথাপি ঐ অক্ষরেখায় দণ্ডায়মান হইয়া আমরা যে কোন কক্ষে প্রবেশ করিতে পারি। এই অক্ষরেখাই ঈশ্বর। এখানে আমরা তাহার সহিত এক, এখানে আমরা সকলেই পরস্পরের মধ্যে এবং সকলেইঈশ্বরে অবস্থিত।