আমাদের গুরুদেবকে ‘আপ্তপুরুষ’ বলিয়া যাহাদের বিশ্বাস, তাহাদের নিকট পূর্বোক্ত উক্তিসকলের একটি নিজস্ব মূল্য থাকিবে। তারা প্রাণে প্রাণে অনুভব করিবেন, যেখানে স্বামীজী শুধু কোন অনুমান অথবা মত প্রকাশ করিতেছেন মাত্র, সেখানেও ঐ মতবাদ কোন অনন্যসাধারণ উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমেরিকায় তাঁহার প্রথম পর্বের কাজ প্রায় শেষ হইবার পর, ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে ইংলণ্ড আগমনের অব্যবহিত পূর্বে, তিনি তাঁহার ধর্মপ্রচার কার্য সুসম্বদ্ধ করিবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বলিয়া বোধ হয়। মনে হয়, প্রথমে তাহার জ্ঞান ও চিন্তাসম্পদ অকাতরে দান করিবার পর, তিনি উহাদের বিশালতা উপলব্ধি করেন, স্পষ্টভাবে উহাদের বিশেষত্ব দেখিতে পান এবং বুঝিতে পারেন যে, এখন কয়েকটি প্রধান ভাবাদর্শকে কেন্দ্র করিয়া উহাদের একত্র গ্রথিত ও সংহত করা চলিতে পারে। সম্ভবতঃ ঐ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াই তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন যে, সর্বসম্মতরূপে বেদান্তকে গ্রহণীয় করিতে হইলে দেহান্তে আত্মার গতি সম্পর্কে কিছু বলা অবশ্যই প্রয়োজন। ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রথম ইংলণ্ড আগমনকালে জনৈক ইংরেজ বন্ধুকে লিখিত তাঁহার পত্র হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন ধর্মমতকে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ করিবার জন্য, উহাতে কোন্ কোন্ বিষয়ের সমাবেশ থাকা আবশ্যক, সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। বর্তমান ক্ষেত্রে দুইজন যুবকের সাক্ষাৎকার কর্মকাণ্ডের আবশ্যকতার প্রতি তাহার দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। যুবকদ্বয় সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, “যাহারা দর্শনশাস্ত্রের দিক হইতে ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করিয়া থাকেন, অলৌকিক রহস্যাদির সহিত কোন প্রকার সম্পর্ক রাখেন না।” তিনি লিখিয়াছিলেন, “এই ব্যাপার আমার চোখ খুলিয়া দিয়াছে। সাধারণ লোকের জন্য কোন প্রকার অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ দৃষ্টিতে ধর্ম শুধু প্রতীকাদি ও কর্মকাণ্ডের সাহায্যেই বাস্তব দর্শনে পরিণত হয়। কেবল শুষ্ক দর্শন মানুষের উপরে তেমন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না।”
এইরূপে যে সংগঠনমূলক কল্পনা (যাহা শুধু ভাঙে না, নূতন কিছু গড়িতে চায়) তাহার মধ্যে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল, তাহার উল্লেখ উপরি-উক্ত বন্ধুকে লিখিত পরবর্তী দুই-তিনখানি পত্রে দেখিতে পাওয়া যায়। জনৈক বিখ্যাত তড়িৎ-তত্ত্ববিদের সহিত আলাপ-আলোচনার উত্তেজনা তখনও পর্যন্ত মনে ক্রিয়াশীল থাকায় তিনি একখানি পত্রে প্রাণ ও জড়ের সম্পর্করূপ সমস্যাটির সম্মুখীন হন, এবং মৃত্যু সম্বন্ধে হিন্দুশাস্ত্রে নিহিত যে তথ্য তাহার নিকট তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হয়, উহার একটি সংক্ষিপ্ত সার সঙ্কলন করিয়া দেন। পত্রখানি পড়িলেই সহজেই বুঝা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় চিন্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়া তিনি বিশেষ আনন্দ অনুভব করেন। তিনি লেখেন, “আমাদের বন্ধু বেদান্তোক্ত প্রাণ, আকাশ ও কল্পের তত্ত্বশ্রবণে মুগ্ধ হইয়াছেন; তাহার মতে এইসব তত্ত্বই কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের গ্রাহ্য। এই প্রাণ ও আকাশ উভয়েই সমষ্টি মহৎ বা সমষ্টি মন বা ব্রহ্মা অথবা ঈশ্বর হইতে উৎপন্ন। তিনি মনে করেন, গণিতশাস্ত্রের দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে, প্রাণ ও জড় উভয়কেই অব্যক্ত শক্তিতে পরিণত (রূপান্তরিত করা যাইতে পারে। আগামী সপ্তাহে তাহার নিকট গিয়া ঐ নূতন গণিতের প্রমাণ দেখিয়া আসিব, এইরূপ স্থির আছে।
“তাহা হইলে বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব অতীব দৃঢ়ভিত্তির উপর স্থাপিত হইবে। বর্তমানে আমি বেদান্তের সৃষ্টিতত্ত্ব ও জীবাত্মার গতি সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করিতেছি। আধুনিক বিজ্ঞানের সহিত উহাদের সম্পূর্ণ ঐক্য আমি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি, এবং একটি তত্ত্বের সরল প্রতিপাদন দ্বারা অপর তত্ত্বটিও সহজ হইয়া যাইবে। পরে প্রশ্নোত্তর আকারে একখানি গ্রন্থ লিখিবার ইচ্ছা আছে। ঐ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় হইবে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক, এবং উহাতে বৈদান্তিক তত্ত্বসমূহ ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রদর্শন করা হইবে।
“জীবাত্মার গতি কেবল অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ হইতে ব্যাখ্যা করা হইবে। অর্থাৎ দ্বৈতবাদীর মতে মৃত্যুর পর জীবাত্মা যথাক্রমে সূর্যলোক, চন্দ্রলোক ও বিদ্যুৎ-লোকে উত্তরণ করেন, সেখান হইতে এক অলৌকিক পুরুষ তাহাকে সঙ্গে করিয়া ব্ৰহ্মলোকে লইয়া যান। (অদ্বৈতবাদী বলেন, সেখান হইতে তিনি নির্বাণ প্রাপ্ত হন।)
“অদ্বৈতমতে আত্মা গমনাগমন করেন না, এবং এই সব লোক বা জগতের বিভিন্ন স্তর আকাশ ও প্রাণের সংযোগে উৎপন্ন বিভিন্ন পরিণাম মাত্র। অর্থাৎ সর্বনিম্ন বা সর্বাপেক্ষা ঘনীভূত স্থূল স্তর হইল সূর্যলোক—যেখানে প্রাণের প্রকাশ জড়শক্তিরূপে এবং আকাশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জড়পদার্থরূপে প্রকাশ পায়। ইহার পর সূর্যলোক বেষ্টন করিয়া অবস্থিত চন্দ্রলোক। চন্দ্রলোক বলিতে আদৌ চন্দ্ৰ বুঝায় না—পরন্তু উহাদেবতাদের আবাসস্থল, অর্থাৎ প্রাণ মনঃশক্তিরূপে এবং আকাশ তন্মাত্রারূপে প্রকাশ পায়। অতঃপর বিদ্যুৎ-লোক, অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা যেখানে প্রাণ আকাশ হইতে প্রায় অবিচ্ছেদ, এবং বিদ্যুৎ প্রাণ অথবা জড়, তাহা ঠিক করিয়া বলা কঠিন। পরবর্তী স্তর ব্রহ্মলোক, সেখানে প্রাণ বা আকাশ কিছুই নাই, উভয়েই মহৎ অথবা আদিশক্তিতে লীন হইয়া গিয়াছে। প্রাণ অথবা আকাশ কিছুই না থাকায় এই অবস্থায় জীব সমগ্র জগৎকে সমষ্টি মহৎরূপে ভাবনা করেন। এই অবস্থা বৈরাজ-পুরুষরূপে প্রতিভাত হয়, তথাপি ইহা ব্ৰহ্ম নহে, কারণ তখনও বহুত্বের ভাব রহিয়াছে। এখান হইতে অবশেষে জীব সেই একত্বে উপনীত হন, উহাই চরম লক্ষ্য। অদ্বৈতবাদ বলে, এই বিভিন্ন অবস্থান্তর বা পরিণাম জীবের মনে ক্রমান্বয়ে উদিত কল্পনামাত্র; জীব স্বয়ং আসেন না বা যান না; এবং এইরূপেই বর্তমান পরিদৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি হইয়াছে। সৃষ্টি ও প্রলয় একই পর্যায়ক্রমে ঘটিয়া থাকে, কেবল একটির অর্থ বিকাশ অন্যটির অর্থ সঙ্কোচ।