তথাপি স্বামীজী এ বিষয়ে অপরের মানিয়া লইবার জন্য কোন বাধাধরা সিদ্ধান্ত নির্দেশ করেন নাই। যাহারা তাহার নিকট থাকিতেন, তাঁহাদের তিনি সত্য সম্পর্কে নিজ দর্শন-শক্তি সহায়ে এবং উপলব্ধ সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য যে চেষ্টা করিতেন তাহারই প্রভাবে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজ নিজ ক্ষমতানুযায়ী তাহারা যতদূর পারেন ততদূর তাহাদের লইয়া যাইতেন। কিন্তু কোন অপরিবর্তনীয় মতামতের তিনি ধার ধারিতেন না, এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার একান্ত বিরোধী ছিলেন। যেমন পূর্বেই বলা হইয়াছে, যত দিন যাইতে লাগিল, মৃত্যুর পর আত্মার কি গতি হয়?—এই প্রশ্নের উত্তরে তাহার একমাত্র বক্তব্য হইয়া দাঁড়াইল, “আমি বলতে পারি না।” তাহার মতে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করিয়া নিজের বিশ্বাস গঠন করিয়া লইতে হইবে। কাহারও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্বাধীন পরিণতির পথে তাঁহার মুখের কোন কথা যেন বাধা প্রদান না করে।
তবে কয়েকটি জিনিস আমরা লক্ষ্য করিয়াছিলাম। মৃত্যুর পর যাহারা অর্থে চলিয়া গিয়াছেন সেই সব পরলোকগত ব্যক্তির সহিত আমরা মিলিত হই এবং নানা বিষয়ের প্রসঙ্গ করিয়া থাকি, লোকের এই প্রচলিত বিশ্বাস তাহারও ছিল বলিয়া বোধ হয়। শ্রীরামকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করিয়া খেয়ালী অথচ কোমল ভাষায় হাসিতে হাসিতে তিনি বলিতেন, “যখন বুড়োর সামনে দাঁড়াব, তখন যেন আমাকে জবাবদিহি না করতে হয়। এই ধারণার বিরুদ্ধে তাহাকে প্রবল ওজর-আপত্তি করিতে শুনি নাই। জীবনের নানা সত্য ঘটনার অন্যতমরূপে ইহাকে তিনি অতি সহজভাবে গ্রহণ করিতেন।
যিনি একবার নির্বিকল্প সমাধিতে আরোহণ করিয়াছেন, গন্তব্যপথে তিনি নিশ্চয়ই নানাপ্রকার মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়া গিয়াছেন, যাহা অশরীরী অবস্থারই অনুরূপ। ঐকালে তাহার এমন অনেক উপলব্ধি হইয়া থাকিবে, সাধারণতঃ আমরা যাহা হইতে বঞ্চিত। স্বামীজী বিশ্বাস করিতেন যে, মধ্যে মধ্যে মৃত ব্যক্তিগণের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হইয়াছে। অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা সম্বন্ধে (ভূতপ্রেতাদি) একজন নিজের ভয়ের বিষয় উল্লেখ করিলে স্বামীজী বলেন, “ইহা কাল্পনিক মাত্র। যেদিন তুমি সত্যই ভূত দেখবে, সেদিন তোমার আর কোন ভয় থাকবে না।” তাহার গুরুভ্রাতাদের মধ্যে এই সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। একবার মাদ্রাজে কয়েকজন আত্মহত্যাকারীর প্রেতাত্মা স্বামীজীর নিকট আর্বিভূত হইয়া তাহাদের দলে যোগ দিবার জন্য তাহাকে পীড়াপীড়ি করে। তাহার জননী পরলোকগমন করিয়াছেন এই বলিয়া ঐ প্রেতাত্মারা তাহাকে বিলক্ষণ বিচলিত করে। অনুসন্ধান দ্বারা স্বামীজী জানিতে পারেন, তাঁহার মাতা কুশলে আছেন। অতঃপর ঐ প্রেতাত্মাগণকে তিনি মিথ্যাভাষণের জন্য তিরস্কার করেন। উত্তরে তাহারা বলে, তাহারা বর্তমানে এত অশান্তি ও যন্ত্রণার মধ্যে রহিয়াছে যে, সত্য অথবা মিথ্যা বলা সম্পর্কে তাহাদের কোন খেয়াল নাই। মুক্তিলাভের জন্য তাহারা স্বামীজীর নিকট প্রার্থনা করে। তিনিও রাত্রিকালে তাহাদের শ্রাদ্ধকৰ্ম করিবার উদ্দেশ্যে সমুদ্রতীরে গমন করেন। কিন্তু শ্রাদ্ধকৰ্ম উপলক্ষে যেখানে পিণ্ডদানের ব্যবস্থা আছে, সেখানে গিয়া যখন দেখিলেন, পিণ্ড দিবার কোন ব্যবস্থা নিকটে নাই তখন, প্রথমে তিনি কি করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। অতঃপর এক প্রাচীন শাস্ত্রবচন তাহার মনে পড়িল যে, অন্ন পিণ্ডের অভাবে বালুকার পিণ্ড দেওয়া যাইতে পারে। তখন তিনি অঞ্জলি ভরিয়া বালুকা গ্রহণ করিয়া সমুদ্রতটে দাঁড়াইয়া মৃত ব্যক্তিগণের উদ্দেশে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করিতে করিতে ঐ পিণ্ড সমুদ্রে নিক্ষেপ করিলেন। সেইসব প্রেতাত্মারাও শান্তিলাভ করে এবং আর কখনও তাহাকে বিরক্ত করে নাই।
আর একটি অভিজ্ঞতাও তিনি কখনও বিস্মৃত হইতে পারেন নাই—শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরবর্তী সপ্তাহে তাঁহার চকিত দর্শনলাভ। তখন রাত্রিকাল; স্বামীজী ও অপর একজন কাশীপুরের বাড়ির বাহিরে বসিয়া কথাবার্তা বলিতেছিলেন। যে দুর্বিষহ শোক ঐকালে তাহাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল, সন্দেহ নাই, তাহারই প্রসঙ্গ চলিতেছিল। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে গুরুদেব তাহাদের পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। সহসা স্বামীজী দেখিলেন, এক জ্যোতির্ময় মূর্তি উদ্যানে প্রবেশপূর্বক তাহাদের দিকে অগ্রসর হইতেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে তাহার বন্ধু রুদ্ধকণ্ঠে অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ওকি দেখলাম, কি দেখলাম?” দুই ব্যক্তির একই সময়ে কোন ছায়ামূর্তি দর্শনের ঘটনা অতি বিরল। বর্তমান ক্ষেত্রে কিন্তু তাহাই ঘটিয়াছিল।
এই প্রকার অনুভূতি যিনি লাভ করেন, তাহার মনের মধ্যে উহা সহজেই কতকগুলি বিশ্বাস উৎপাদন করিয়া থাকে। ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘সহস্র দ্বীপোদ্যান’ হইতে লিখিত এক পত্রে স্বামীজী উক্ত বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, “যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই স্পষ্টই দেখিতে পাইতেছি, কেন হিন্দুগণ মানুষকেই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলিয়া থাকেন। যাহারা পরলোক গমন করিয়াছে, তাহারাই একমাত্র তথাকথিত উচ্চতর শ্রেণী, কিন্তু তাহারাও অপর সূক্ষ্মদেহধারী মানুষ ব্যতীত আর কিছু নয়। সত্য, ঐ দেহ সূক্ষ্মতর কিন্তু হস্তপদবিশিষ্ট মানুষেরই দেহ। তাহারা এই পৃথিবীর অপর কোন স্তরে বাস করে, এবং একেবারে অদৃশ্যও নহে। তাহারাও চিন্তা করে, আমাদের মতো তাহাদেরও মন, চৈতন্য ইত্যাদি সবই আছে। অতএব তাহারাও মানুষ। দেবগণ ও দেবদূতগণও তাহাই। কিন্তু কেবল মানুষই ব্ৰহ্মস্বরূপ হয় এবং ঐ ব্ৰহ্মত্ব লাভ করিবার জন্য অপর সকলকে পুনরায় মানবজন্ম গ্রহণ করিতে হয়।”