আত্মা ও দেহ সম্বন্ধে এই নূতন ব্যাখ্যার ফলস্বরূপ লোকদের সহিত কথা বলিবার সময় আমি ঐ বিষয়টি পরীক্ষামূলকভাবে নিজেকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম যে, বাহ্য শ্রবণেন্দ্রিয়ের পরিবর্তে আমি তাহাদের ভিতরের মনের সহিত কথা কহিতেছি। এই পরীক্ষায় যে বিপুল পরিমাণে সাড়া পাইল, তাহাই আমাকে ক্রমশঃ অগ্রসর করিয়া লইয়া চলিল; অবশেষে বৎসরান্তে সহসা একদিন আবিষ্কার করিলাম যে, মনকে প্রাধান্য দেওয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। ফলে শরীর নাশের সঙ্গে সঙ্গে মনের বিনাশ আমি আর কল্পনা করিতে পারিলাম না। প্রত্যেক নূতন প্রচেষ্টা এই বিশ্বাস দৃঢ়তর করিতে লাগিল এবং ক্রমশঃ নিশ্চিতভাবে এই ধারণা হইয়া গেল যে, এই পরিদৃশ্যমান জগৎবাস্তবিকই মনঃপ্রসূত; এবং কোন এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে (যেমন, দেহত্যাগকালে) চিন্তারাজ্যে কোন আকস্মিক বিরাট পরিবর্তন ঘটা অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
কিন্তু ঐ বিষয়ে স্বামীজীর চিন্তা অনেক গভীরতর ছিল। তাহার সর্বদা চেষ্টা ছিল কোন প্রকারে যেন দেহাত্মবুদ্ধি না আসিতে পারে। ‘আমি’ শব্দটি তিনি কখনও এমনভাবে প্রয়োগ করিতেন না, যাহাতে কেহ ঐরূপ অর্থ করিতে পারে; বরং ঈষৎ অঙ্গভঙ্গির সহিত ‘এইটা বা এইসব’ বলিয়া শরীরকে নির্দেশ করিতেন। অবশ্য পাশ্চাত্যবাসীর কর্ণে উহা কিঞ্চিং অদ্ভুত শুনাইত। কিন্তু সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব দ্বারা সীমিত ইন্দ্রিয়নির্ভর জীবনকে জীবন বলিয়াই তিনি স্বীকার করিতে চাহিতেন না, কারণ উহাতে অনেক গোলমালের আশঙ্কা উঠিতে পারে। জয়-পরাজয়, ভালাবাসা-ঘৃণা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা—প্রত্যেকটি ব্রহ্মের আংশিক প্রকাশ মাত্র এবং সেজন্য কখনই সম্মিলিতভাবে তাহারা সেই সচ্চিদানন্দস্বরূপ হইতে পারে না। স্বামীজী যেমন বলিতেন, আমাদের বর্তমান জীবনের ন্যায় শত শত জীবন, যথাকালে যাহার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, তাহার দ্বারা অমৃতত্ব-পিপাসার নিবৃত্তি কদাপি সম্ভব নহে। অতএব মরণ-রহিত অবস্থালাভ ব্যতীত অপর কিছুই চলিবে না, এবং এই অবস্থাকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ জীবনেরই বহুল পুনরাবৃত্তি, অথবা তাহারই কিঞ্চিৎ বিকাশপ্রাপ্ত অবস্থামাত্র বলিয়া কদাপি ব্যাখ্যা করা যায় না। এ বিষয়ে স্থির নিশ্চয়তার জন্য ইহজীবনেই অমৃতত্ব লাভ করা প্রয়োজন, নতুবা আর অন্য কোন উপায়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাইতে পারে যে, আমরা শরীরবোধকে অতিক্রম করিতে পারিতেছি? পাশ্চাত্যবাদীরা বলিতে অভ্যস্ত, ‘আত্মা আসেন এবং যান; এইরূপে তাঁহারা দেহাত্মবুদ্ধি প্রবণতার পরিচয় দেন; যেন তাহারা এক উচ্চতর সত্তার আগমনির্গম প্রত্যক্ষ করিতেছেন। সেন্ট অগাস্টিনকে অভিনন্দনপূর্বক কেন্টপ্রদেশবাসী ডুইড পুরোহিত প্রদত্ত বক্তৃতাই একশ্রেণীর লোকের ধর্মবিশ্বাসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইহাদের মতে, জগৎ একটি উষ্ণ, আলোকিত বৃহৎকক্ষ, এবং আত্মা যেন একটি পক্ষী, বাহিরে শীত ও ঝঞাবাত হইতে রক্ষা পাইবার নিমিত্ত ক্ষণকালের জন্য ঐ কক্ষে আশ্রয় লইয়াছে। তথাপি ইহার বিপরীত ধারণার ন্যায় এই ধারণাতেও, অনুরূপ বহু বিষয় সত্য বলিয়া ধরিয়া লওয়া হইয়াছে। যিনি বিচার দ্বারা দৃঢ়ভাবে এই ধারণায় উপনীত হন যে, আমরা আদৌ কতকগুলি ভৌতিক এককের সমষ্টি নই, পরন্তু ভৌতিক পদার্থের সীমানার বাহিরে এক অখণ্ড বস্তু, যাহা ঐ ভৌতিক পদার্থগুলিকে আলগাভাবে ধরিয়া রাখিয়াছে, তাহার নিকট সমভাবেই একথা সত্য যে, আমরা প্রকৃতপক্ষে এইমাত্র জানি “দেহই আসে ও যায়।”
এইরূপে ক্রমাগত মানুষকে শরীরের পরিবর্তে আত্মা বলিয়া চিন্তা করিবার উপর জোর দেওয়ায়, যাহারা স্বামীজীর সঙ্গলাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট মৃত্যু আর একটা অবশ্যম্ভাবী অন্তিম অবস্থা (যাহার পর আর কিছু নাই) বলিয়া বোধ হয় না; মৃত্যু তাহাদের নিকট আত্মার অবিচ্ছিন্ন অনুভূতিরূপ শৃঙ্খলের একটা আংটা মাত্র বলিয়া প্রতীত হয়। এইরূপে আমাদের সমগ্র দৃষ্টিকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটিয়া গেল। আলোকিত কক্ষের পরিবর্তে জীবন আমাদের নিকট মোহ ও অজ্ঞানময় কারাগারে অথবা বিচ্ছিন্ন ক্ষণিক চেতনাময় স্বপ্নে সঞ্চরণ বলিয়া বোধ হইল। বাক্যোচ্চারণ কি চিরকাল মানবীয় ভাষার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন ও নিয়ন্ত্রিত থাকিয়া যাইবে? মধ্যে মধ্যে আমরা কি এই সকলের পারে অবস্থিত এমন একটা কিছুর ক্ষণিক আভাস পাই না, এমন এক সত্তার, বাক্যের সাহায্য ব্যতীত যাহা আমাদের কার্যে প্রবৃত্ত করায়, বাহ্য শিক্ষার অপেক্ষা না করিয়া যাহা আমাদের অন্তর জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে যাহা অপরোক্ষ, গভীর এবং প্রাণে প্রাণে উপলব্ধিস্বরূপ? জ্ঞান কি চিরকালই সসীম এবং অস্পষ্ট পুরাতন ইন্দ্রিয়-অনুভূতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকিবে আর চিরদিন কঠোর ও সঙ্কীর্ণ আচরণবিধির মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করিবে? নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত একটি বক্তৃতায় স্বামীজী যেন প্রাণের গভীর কাতরতা হইতে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “অনন্ত অসীম স্বপ্নদ্রষ্টী মানব সান্ত পরিচ্ছিন্ন স্বপ্নে মগ্ন!”
এইপ্রকার ধারণাসমূহ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দর্শন, তাহার নিজের সর্বদা মৌনাবলম্বনপূর্বক গম্বরমাত্র হইয়া গঙ্গার তীরে প্রব্রজ্যার একান্ত আকাঙক্ষা, সমাধি অবস্থালাভই একমাত্র বাঞ্ছনীয় জ্ঞান বলিয়া অবিরত নির্দেশ প্রদান এবং আত্মার স্বাধীনতার পক্ষে জাগতিক সম্বন্ধগুলি বন্ধন ও বিঘ্নস্বরূপ এই দৃষ্টিভঙ্গি—প্রকৃতপক্ষে এইসকল উপায়ে স্বামী বিবেকানন্দ তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণের হাতে যেন একটা মাপকাঠি দিয়া গিয়াছিলেন, যাহা দ্বারা প্রকৃত সত্তা কি, তাহা নিরূপণ করা চলে। ইহার ফলে শরীর নাশের সঙ্গে সঙ্গে ঐ প্রকৃত সত্তার মধ্যে কোন গুরুতর পরিবর্তন ঘটিতে পারে, এ ধারণা ক্রমশঃ তাঁহাদের নিকট অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। এই ধারণা আমাদের মজ্জাগত হইয়াছিল যে, জীবনের আনুষঙ্গিক সুখ-দুঃখ প্রভৃতি একটা ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নের বাহ্য অবয়ব মাত্র, এবং স্পষ্ট বোধ করিতাম, আমাদের এই জীবনযাত্রা মৃত্যুর পূর্বের ন্যায় মৃত্যুর পরেও বর্তমানের মতো অব্যাহত থাকিবে; কেবল এইটুকু পার্থক্য ঘটিবে যে, মৃত্যুর পরে সূক্ষ্মতর দেহ অবলম্বনহেতু গতির তীব্রতা বর্ধিত হইবে। আর ইহাও আমাদের নিকট স্পষ্টতর হইয়াছিল যে, তিনি যেমন বলিতেন—ইহজীবনের কর্মপ্রসূত ‘অনন্ত’ স্বর্গ অথবা নরক একটা অবাস্তব কথার কথামাত্র, সসীম কারণ কোন উপায়ের মাধ্যমেই অনন্ত ফল প্রসব করিতে পারে না।