স্বামীজীর মতে ভূতপ্রেতাদি লইয়া বেশি নাড়াচাড়া করার ফলে বাসনা ও অহঙ্কারের বৃদ্ধি হয়, এবং অসত্যে পতন অনিবার্য হইয়া পড়ে। যদি আত্মার জন্য জীবনের সাধারণ ভোগ-বাসনাই পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহা হইলে এইসকল অলৌকিক ক্ষমতা আরও কতক অধিক পরিমাণে ত্যাজ্য! এমনকি, খ্রীস্টধর্মে সিদ্ধাই-এর ব্যাপার যদি না থাকিত, তাহা হইলে তিনি উহাকে উচ্চতর ধর্ম বলিয়া মনে করিতে পারিতেন। সিদ্ধাই-এর প্রতি ভগবান বুদ্ধের দারুণ ঘৃণা বৌদ্ধধর্মের চিরন্তন গৌরব। উহাদের মূল্য সম্পর্কে বড় জোর এই কথা বলা যায় যে, উহারা বিশ্বাস-উৎপাদনে কিঞ্চিৎ সাহায্য করে, তাহাও আবার ধর্মশিক্ষার প্রথম স্তরে। বাইবেলের ভাষায়, “সিদ্ধাই প্রভৃতি যাহা কিছু সব লোপ পাইবে। একমাত্র প্রেমই চিরকাল থাকিবে।” যে দৃঢ়চেতা ব্যক্তি এইসব প্রলোভন দূর করিতে পারেন, তাহার নিকটেই সত্যের দ্বার উদঘাটিত হয়। মহর্ষি পতঞ্জলির কথায়, “প্রসংখ্যানেহপ্যকুসীদস্য সর্বথা বিবেকখ্যাতেধর্মমেঘঃ সমাধিঃ”—যিনি সিদ্ধিসমূহ সমূলে পরিহার করিতে সমর্থ হন, তাহারই ধর্মমেঘ নামক সমাধিলাভ হয়; তিনিই ব্ৰহ্ম উপলব্ধি করেন।
———–
১ যেমন, দাক্ষিণাত্যে একব্যক্তি মনের কথা বলিয়া দিবার ক্ষমতার জন্য বিশেষ খ্যাতিলাভ করে। সে বলিত, এক অদৃশ্য স্ত্রীমূর্তি তাহার নিকট দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিয়া দিত, তাহাকে কি বলিতে হইবে। স্বামীজী বলিতেন, “এই ব্যাখ্যা আমার পছন্দ না হওয়ায় আমি অপর ব্যাখ্যার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সে নিজের ভিতর হইতেই ঐসকল তথ্য লাভ করিত
২৪. মৃত্যু সম্বন্ধে স্বামীজীর শিক্ষা
আমাদের আচার্যদেব যে-সকল উপায় অবলম্বনে শিক্ষা প্রদান করিতেন, তাহার মধ্যে অন্যতম অতীব হৃদয়গ্রাহী হইল যে, তাহার সান্নিধ্যই শিষ্যের মধ্যে নীরবে অজ্ঞাতসারে একটা পরিবর্তন আনিয়া দিত। তাহার সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটিত, কোন একটি নির্দিষ্টভাবে সে অনুপ্রাণিত হইয়া যাইত, অথবা সহসা দেখিতে পাইত, কোন বিশেষভাবে চিন্তা করিবার সমগ্র অভ্যাস চলিয়া গিয়াছে এবং উহার স্থলে একটি নূতন মতের উদ্ভব হইয়াছে—অথচ ঐ বিষয়ে উভয়ের মধ্যে একটি কথারও আদানপ্রদান হয় নাই। মনে হইত, তাহার সান্নিধ্যে অবস্থানহেতুই যেন কোন বস্তু তর্কযুক্তির রাজ্য অতিক্রম করিয়া গিয়াছে এবং আপনা হইতে ঐ সম্পর্কে জ্ঞান জন্মিয়াছে। এইরূপেই রুচি ও মূল্য-সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন যেন অবাস্তব হইয়া যাইত। এইরূপেই তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণের হৃদয়ে ত্যাগের বাসনা জ্বলন্ত অনলশিখার ন্যায় উদ্দীপিত হইয়া উঠিত। আর তাহার সান্নিধ্যে মৃত্যু সম্বন্ধে লোকের মনে যে ধারণা সঞ্চারিত হইত, তৎসম্পর্কে এই কথাটি সর্বাপেক্ষা প্রযোজ্য।
তাহার জীবিতকালে এ-বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম প্রবর্তন করার ব্যাপারে তিনি ক্রমশঃ অধিকতর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই চিরন্তন সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় তাহার মতামত কেহ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি উত্তর দিতেন, “আমার মনে হয় এইরকম, আমি ঠিক জানি না।” সম্ভবতঃ তিনি অনুভব করিতেন, ভবিষ্যৎ সুখের আনন্দময় স্বপ্নের মধ্যে একপ্রকার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্বার্থপরতা থাকে এবং দেহত্যাগের পরের অবস্থার উপর ঝোক দিয়া লোকের বাসনাজনিত অজ্ঞতা বর্ধিত করিতে তিনি ভয় পাইতেন। তাহার নিজের পক্ষে জীবন ও মরণে ঈশ্বরই একমাত্র উপায় এবং নির্বাণই ছিল একমাত্র চরম লক্ষ্য। “সর্বোচ্চস্তরের সমাধিই একমাত্র প্রয়োজনীয় বস্তু, বাকি আর সবই বাজে জিনিস।” তথাপি এই তথ্য হইতেই স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কিরূপে তাহার শিক্ষায় লোকের মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন ঘটিত, এবং যে দুই-তিনখানি পত্রে ব্যক্তিগত অনুভব ও সহানুভূতির প্রেরণায় এ সম্পর্কে তিনি নির্দিষ্ট একটি মত প্রকাশ করিয়াছিলেন, উহাই পত্রগুলিকে সমধিক মূল্যবান করিয়া তুলিয়াছে।
আমার নিজের কথা বলিতে গেলে যখন আমি স্বামীজীর প্রথম সাক্ষাৎ লাভ করি তার পূর্ব হইতেই এই ধারণা আমার হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল যে, আমাদের ইচ্ছা যাহাই হউক, শরীর ত্যাগের পরেও আমাদের ব্যক্তিত্ব বজায় থাকে, এরূপ কল্পনা করিবার কোন বাস্তব কারণ নাই। এরূপ ব্যাপার হয় অসম্ভব, না হয় অচিন্তনীয়। মন ব্যতীত যদি শরীরের অনুভূতি না হয় (কারণ, মন দ্বারাই আমরা ঐ অনুভূতি লাভ করিয়া থাকি), তাহা হইলে ইহাও সত্য যে, শরীর ব্যতীত মনের অস্তিত্বও আদৌ কল্পনা করিতে পারি না। সুতরাং মন যদি “বীণার তারে ঝঙ্কারের মতো” বাস্তবিক শরীরের পরিণাম না হয়, তাহা হইলেও অন্ততঃ আমাদের স্বীকার করিতে হইবে যে, শরীর ও মন উভয়ে একই বস্তুর বিপরীত প্রান্ত মাত্র। শরীর ও মন–জড়পদার্থ ও মন নয়—উহারা একই জিনিস, এবং মৃত্যুর পরেও ব্যক্তিরূপে অস্তিত্বের ধারণা জৈব-সংস্কারপ্রসূত একটা ছায়া মাত্র। নৈতিক আচরণ, এমনকি পূর্ণ আত্মত্যাগে যাহার পরিণতি, তাহাও আমাদের ব্যক্তিগতভাবে সমাজের পক্ষে কল্যাণকর ভোগগুলিকে গ্রহণ করা-রূপ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।(১)
ভারতের মনীষিবৃন্দ মনকেই জীবনের কেন্দ্রবিন্দু জ্ঞান করিয়া অভ্যাস অনুযায়ী উহার উপরেই সর্বপ্রকার জোর দিয়া থাকেন। আমার নিজের ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত ধারণাসমূহ তাহাদের ঐ প্রকার চিন্তা দ্বারা ব্যাহত হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ব্যক্তির বিশ্বাস যে, মানুষ একটা দেহ। এ বিষয়ে প্রাচ্য পণ্ডিতগণ সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা পোষণ করেন, কারণ, ঐ সংস্কার তাহাদের মজ্জাগত। স্বামীজী যেমন নির্দেশ করিয়াছিলেন, “পাশ্চাত্যের সকল ভাষায় বলা হয়, মানুষ একটি দেহ এবং তার আত্মা আছে; কিন্তু প্রাচ্য ভাষাগুলিতে বলা হয় যে, মানুষ আত্মা; এবং তার একটা দেহ আছে।”