প্রকৃত অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের সহিত বিচারবুদ্ধির কখনও বিরোধ থাকিতে পারে না—’রাজযোগে লিপিবদ্ধ এই উক্তির সত্যতাও নিঃসন্দেহে তাহার উপলব্ধির বিস্তৃত জ্ঞানরাজ্যের অভিজ্ঞতা-প্রসূত। দক্ষিণেশ্বরের ঐ সাধুর নানা অসাধারণ উপায়ে অতীন্দ্রিয় জ্ঞানলাভ করিবার ক্ষমতা ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু সেজন্য বৃথা অভিমানে আত্মহারা হইয়া সাধারণ উপায়ে যাহা নিশ্চিত জানা যায়, তাহা জানিবার জন্য তিনি কখনও অসাধারণ উপায় অবলম্বন করিবার প্রয়াস পাইতেন না। একবার এক অদ্ভুত সাধুবেশধারী ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বর উদ্যানে আসিয়া বলে যে, সে আহার ব্যতীত জীবনধারণ করিতে পারে। তাহাকে পরীক্ষা করার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ কোন অলৌকিক দর্শনের সাহায্য লইবার চেষ্টা করিলেন না, কেবল কয়েকজন চতুর প্রকৃতির লোক পাঠাইয়া দিলেন, তাহার উপর নজর রাখিবার জন্য, এবং বলিয়া দিলেন, ঐ ব্যক্তি কি আহার করে এবং কোথায় আহার করে তাহা যেন তাহাকে জানায়।
পরীক্ষা না করিয়া কোন জিনিস গ্রহণ করা চলিবে না, এবং স্বপ্ন, পূর্ব হইতে ভাবী ঘটনা দর্শন করা ও তৎসম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা ইত্যাদি যে-সব উপায়ে সাধারণ লোক পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করিবার জন্য এত চেষ্টা করিয়া থাকে, দেহত্যাগের দিন পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দের নিকট ঐ সকল আতঙ্কের বস্তু ছিল। আবার লোকে ঐ সকল তাহার নিকট প্রভূত পরিমাণে উপস্থিত করিত। অবশ্য উহা কবিবারই কথা, স্বামীজী কিন্তু এসব সর্বদা অগ্রাহ্য করিয়া উঠাইয়া দিতেন, এবং বলিতেন, যদি উহারা সত্য হয়, তবে তাহার না মানা সত্ত্বেও নিজ নিজ ফল প্রকাশ করিয়া দেখাক। তিনি বলিতেন, কোন ভবিষ্যদ্বাণী কার্যক্ষেত্রে সত্য হইবে কি-না, সে কথা জানা তাহার পক্ষে অসম্ভব; কেবল এই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, একবার উহা মানিয়া লইলে আর কখনও তিনি উহার হাত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারিবেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষেত্রে দেখা যাইত, অলৌকিক দর্শনাদি কেবল পারমার্থিক বিষয়েই প্রযুক্ত হইত; কদাপি উহার ব্যতিক্রম ঘটিত না। বেদিয়াদের মতো গণনা দ্বারা ঐহিক বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী তিনি কখনও করিতেন না, এবং তাহার শিষ্যগণের মতে ভবিষ্যগণনা শক্তির অল্পবিস্তর অপব্যবহারের সূচনা করে। স্বামীজী বলিতেন, “এসব অবান্তর ব্যাপার, প্রকৃত যোগ নয়। অপরোক্ষভাবে আমাদের কথার সত্যতা প্রমাণ করে বলে এদের কতটা প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। একটু সামান্য আভাসেও মানুষের বিশ্বাস হয় যে স্থূল জড় জগতের বাইরে একটা কিছু আছে। কিন্তু যারা এসব জিনিস নিয়ে সময় কাটায়, তাদের গুরুতর বিপদের আশঙ্কা আছে।” আর একবার অসহিষ্ণুভাবে তিনি বলিয়া ওঠেন, “এসব ‘সীমান্ত-সমস্যার ব্যাপার’ (frontier questions), এগুলোর সাহায্যে কোন নিশ্চিত বা দৃঢ় জ্ঞানলাভ করা যায় না। আমি কি বলিনি, ও-সব ‘সীমান্ত-সমস্যার ব্যাপার? সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা সব সময়েই বদলে যাচ্ছে।”
আমাদের সামনে যাহা কিছু আসুক, বিচারপূর্বক উহা বুঝিবার প্রচেষ্টা সর্বদা থাকা চাই। কাহারও অলৌকিক দর্শনাদির কথা শুনিলে বলিতেই হইবে, নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করলে তবেই আমি ওটা সত্য বলে গ্রহণ করব। কিন্তু আমাদের নিজেদের অনুভূতিকেও সম্পূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করিয়া দেখিতে হইবে। কোন অলৌকিক ঘটনার যে ব্যাখ্যা প্রথমেই মনে আসিল, তাহাকেই সার জ্ঞান করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবে না। চট করিয়া কোন সিদ্ধান্ত মানিয়া লইবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বামীজী শেষের দিকে পরলোকগত আত্মার পুনরাগমন সম্পর্কে বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। একবার ইচ্ছাপূর্বক তিনি বলেন, “আমি জীবনে অনেকবার ভূত দেখেছি এবং একবার শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরসপ্তাহে এক জ্যোতির্ময় অশরীরী আত্মা দেখেছি।” কিন্তু ইহা দ্বারা একথা বুঝায় না যে, ভূতুড়ে কর্তৃক ভূত নামাইবার যে-সকল চেষ্টা ও পরীক্ষা, তাহার অধিকাংশের প্রতি তাহার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল। এইরূপ একদিনের ঘটনায় জনৈক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিকে উক্ত দলভুক্ত দেখিয়া তিনি বলেন, জাগতিক সকল বিষয়ে অসাধারণ বুদ্ধিমান এক ব্যক্তি যে তথাকথিত এক মিডিয়ামের (ভূতাবিষ্ট ব্যক্তির সামনে আসিয়াই সমস্ত বলবুদ্ধি খোয়াইয়া বসে, ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয়। আমেরিকায় কয়েকটি ভূতনামানো ব্যাপারে তিনি দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন, এবং ঐ সময়ে প্রদর্শিত অলৌকিক ব্যাপারের অধিকাংশই তিনি মনে করিতেন সম্পূর্ণ জুয়াচুরি। সব দেখিয়া শুনিয়া তিনি সার মন্তব্য প্রকাশ করেন যে, “সর্বত্রই অতি সহজ উপায়ে অতি বড় জুয়াচুরি চলে থাকে। আবার তিনি মনে করিতেন যে, এই সকল ঘটনার একটা বড় অংশকে বহির্জগতের সত্য না বলিয়া অন্তর্জগতের ব্যাপার হিসাবে ব্যাখ্যা করিলেই ভাল।(১) যদি এই সকল বাদ দিবার পরেও উহাদের কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাহা হইলে সেটুকু বাস্তবিক যথার্থ হওয়া সম্ভব।
কিন্তু যদি এইরূপই হয়, তথাপি এই মায়িক জগতের জ্ঞানলাভ আমাদের চরম লক্ষ্য হইতে পারে না। দুই-চারিজন ভ্রাম্যমাণ জীবের কোন সূক্ষ্ম জগৎ হইতে স্থূল জগতে প্রত্যাবর্তনের দ্বারা অমৃতত্বের প্রকৃত ধারণা সম্বন্ধে অতি অল্প জ্ঞানই লাভ করা যায়। একমাত্র ত্যাগের দ্বারাই এই অমৃতত্ব লাভ করা যায়।