বৌদ্ধজাতকগুলির ইংরেজী অনুবাদের কোন একখণ্ডে এই কথাগুলি বার বার উল্লেখ দেখা যায়, “যখন মানব সেইস্থানে উপনীত হয়, যেখানে সে স্বৰ্গকে নরকের মতোই ভয় করে”—স্বামীজীর উপস্থিতি যে আধ্যাত্মিক অনুভূতি আনয়ন করিত, তাহার পরিচয় ইহা অপেক্ষা অধিকতর স্পষ্টভাবে আর কিরূপে দেওয়া যায়, তাহা আমার অজ্ঞাত। যাহারা ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে তাঁহাকে লণ্ডনে বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে অনেকেই এমন কিছু আভাস পান, যাহা দ্বারা প্রাচ্যবাসিগণ কেন জন্মাল পরিগ্রহ হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতে চাহেন, তাহার কিছুটা অর্থ বুঝিতে পারিয়াছেন।
কিন্তু এই সকল মানসিক অবস্থার মধ্যে যেটি সর্বাপেক্ষা প্রবল হইয়া অপর অবস্থাগুলিকে পরিচালিত করিত, তাহার আভাসমাত্র ইতঃপূর্বে এই কথাগুলিতে ব্যক্ত হইয়াছে—”যদি ইহাই সত্য হয়, তবে আর কোন্ বস্তুতে প্রয়োজন? আর যদি একথা সত্য না হয়, তবে আমাদের জীবনেই বা ফল কী?” কারণ, তিনি স্বয়ং যে সকল সত্য শিক্ষা দিতে আসিয়াছিলেন, এবং নিজে যে সর্বোচ্চ আশা পোষণ করিতেন, তাহাদের একত্র করিয়া এবং অপরের কল্যাণের নিমিত্ত প্রয়োজন বোধ করিলে ঐগুলিকে হীন উৎকোচস্বরূপ জ্ঞান করিয়া নির্ভীকভাবে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা এই আচার্যের ছিল। বহু বৎসর পরে আমার কোন এক মন্তব্যের উত্তরে তিনি সক্রোধে যাহা বলেন, তাহা দ্বারা এই বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়—”যদি আমি কোন গুরুতর অপরাধ করলে, বাস্তবিক কাহারও উপকার হয়, তবে আমি নিশ্চয় এখনই তা করে অনন্ত নরকভোগ করতে প্রস্তুত!” আবার তিনি আমাদের মধ্যে কয়েক জনকে বহুবার সেই বোধিসত্ত্বের যে কাহিনী বলিতেন—যেন উহা বর্তমান যুগের বিশেষ উপযোগী—তাহাতেও এই আবেগই প্রকাশ পাইত। এই বোধিসত্ত্ব যতদিন জগতের শেষ ধূলিকণাটি পর্যন্ত মুক্তিলাভ না করে, ততদিন পর্যন্ত নিজে নির্বাণ গ্রহণ করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করেন। ইহার অর্থ কি এই যে, মুক্তিলাভের শেষ লক্ষণ হইল মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা হইতে বিরত হওয়া? তখন হইতে ভারতে প্রচলিত বহু কাহিনীর মধ্যে আমি এই বিষয়টি লক্ষ্য করিয়াছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, রামানুজের অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া পারিয়াদিগের নিকট পবিত্র মন্ত্র উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা, বুদ্ধের কোন কিছু গোপন না রাখিয়া সমগ্র জীবন কর্মে উৎসর্গ করিয়া দেওয়া, শিশুপালের শীঘ্র শীঘ্র ভগবৎ সকাশে ফিরিয়া যাইবার জন্য ভগবানকে শত্রুভাবে বরণ করিয়া লওয়া; এবং সাধুগণের নিজ নিজ ইষ্টের সহিত দ্বন্দ্ব প্রভৃতি অসংখ্য কাহিনীর উল্লেখ করা যাইতে পারে।
.
কিন্তু সকল সময়েই যে স্বামীজী ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পরিহার করিয়া চলিতেন, তাহা নহে। একদিন বক্তৃতান্তে তিনি আমাদের একটি ছোটখাট দলের নিকট আসিয়া যে প্রসঙ্গের অবতারণা হইয়াছিল তাহারই সম্বন্ধে বলেন, “আমার একটা কুসংস্কার আছে—অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়—যিনি একসময়ে বুদ্ধরূপে এসেছিলেন, তিনিই পরে খ্রীস্টরূপে এসেছেন।” অতঃপর ঐ বিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ক্রমশঃ তাহার গুরুদেবের কথা আসিয়া পড়িল। এই প্রথম আমরা তাহার এবং বিবাহের পর স্বামী কর্তৃক বিস্মৃত হইয়াও যিনি সজলনয়নে তাহাকে নিজ অভীষ্ট পথে চলিবার স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, সেই বালিকার কথা শুনিতে পাইলাম। কথা কহিতে কহিতে ক্রমশঃ তাহার কণ্ঠস্বর মৃদুতর হইয়া অবশেষে স্বপ্নবিষ্টের মতো হইয়া উঠিল। কিন্তু শেষে যেন স্বগতোক্তির মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস সহকারে এই কথা বলিয়া তিনি উক্ত আবেশ হইতে নিজেকে জোর করিয়া মুক্ত করিলেন—”সত্যই, এসব ঘটনা ঘটে গেছে, এবং আবার ঘটবে। যাও বৎসে, শান্তিপূর্ণ হৃদয়ে যাও, তোমার বিশ্বাসই তোমাকে রোগমুক্ত করেছে।”(১)
আর একদিন কথা প্রসঙ্গে ইহা অপেক্ষা সামান্য এক ঘটনা উপলক্ষে তিনি আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “স্বদেশের নারীগণের কল্যাণকল্পে আমার কতকগুলি সঙ্কল্প আছে। আমার মনে হয়, সেগুলিকে কার্যে পরিণত করতে তুমি বিশেষভাবে সাহায্য করতে পার।” আমি বুঝিলাম, আমার নিকট এমন এক আহ্বান আসিয়াছে, যাহা জীবনকে পরিবর্তিত করিয়া দিবে। এই সঙ্কল্পগুলি কী ধরনের তাহা আমি জানিতাম না, এবং ভাবী জীবনের যে চিত্র অঙ্কনে আমি অভ্যস্ত হইয়াছিলাম, তাহা ত্যাগ করা সেই সময়ে এত কষ্টকর বোধ হইয়াছিল যে, ঐ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিতেও চাহি নাই। কিন্তু ইতঃপূর্বেই আমি অনুমান করিয়াছিলাম, জগৎ সম্বন্ধে আমার যে ধারণা, অন্যান্য জাতির দৃষ্টিভঙ্গির সহিত তাহার সামঞ্জস্য করিয়া লইতে গেলে আমাকে অনেক জিনিস শিখিতে হইবে। একবার আমি লণ্ডন নগরীকে সৌন্দর্যশালিনী করার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলিয়াছিলাম। স্বামীজী তীব্ৰস্বরে উত্তর দেন, “আর তোমরা অন্য শহরগুলিকে শ্মশান করে তুলেছ।” আমার নিকট লণ্ডন নগরীর রহস্যময়তা ও দুঃখপূর্ণতা বহুদিন হইতে সমগ্র মানবজাতির সমস্যা বলিয়াই বোধ হইত—সমগ্র জগৎ যাহা চাহিতেছে তাহারই একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। “আর তোমরা তোমাদের এই নগরীকে সৌন্দর্যশালিনী করবার জন্য অন্য নগরগুলিকে শ্মশানপুরী করে তুলেছ।” তিনি আর বেশি কিছু বলিলেন না, কিন্তু কথাগুলি বহুদিন ধরিয়া আমার কানে বাজিতে লাগিল। আমার চক্ষে আমাদের নগরী সৌন্দর্যশালিনী ছিল না। আমার প্রশ্নটি স্বামীজী ভুল বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু এই ভুল বোঝা হইতেই আমি দেখিতে পাইলাম, ইহাকে অপর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা দেখা যায়। স্বামীজী একদিন আমাকে বলেন, “ইংরেজরা দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছে, আর সর্বদা তাদের চেষ্টা দ্বীপেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।” আমার সম্পর্কে এই মন্তব্য যথার্থই সত্য ছিল। পিছনে ফিরিয়া আমার জীবনের ঐ অংশের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বুঝিতে পারি, আমার আদর্শগুলি তখন পর্যন্ত কতদূর সঙ্কীর্ণ ছিল। ইংলণ্ড অবস্থানকালে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমি আর বেশি কিছু জানিতে পারি নাই। যে মহিলা বন্ধু আমায় পরে ভারতে তাহার সহকর্মিণী হইবার জন্য আহ্বান করেন, এক সন্ধ্যাকালে স্বামীজী ও আমি ঘণ্টাখানেকের জন্য লণ্ডনে তাহার গৃহে অতিথি হইলে, আমি স্বামীজীকে জানাই যে, তাহার কার্যে যোগদান করিতে আমার আগ্রহ আছে। স্পষ্টতই তিনি ইহা শুনিয়া বিস্মিত হন, কিন্তু শান্তভাবে বলেন, “আমার কথা বলতে গেলে, আমি স্বদেশবাসীর উন্নতিকল্পে যে কাজে হস্তক্ষেপ করেছি, তা সম্পন্ন করবার জন্য মোন হলে দু শবার জন্মগ্রহণ করব।” এই কথাগুলি এবং অপর কয়েকটি কথা, যাহা তিনি আমার যাত্রার প্রারম্ভে লিখিয়াছিলেন, আমার মানসপটে চিরবিরাজমান রহিয়াছে, “তুমি ভারতের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্তধর্ম ত্যাগই কর আর ধরিয়াই থাক, আমি আমরণ তোমাকে সাহায্য করিব। ‘মরদকী বাত, হাথীকা দাঁত।’ হাতির দাঁত একবার বাহির হইলে আর ভিতরে যায় না। পুরুষের কথাও সেইরূপ।”