শ্রীরামকৃষ্ণের আরও অনেক বিশেষত্ব ছিল। স্নায়ুমণ্ডলীর ক্রিয়ার উপর তাহার কিরূপ সম্পূর্ণ আধিপত্য ছিল, তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, শেষ অসুখের সময় তিনি গলদেশ হইতে মনকে একেবারে তুলিয়া লইতে পারিতেন, ঔষধ প্রয়োগের দ্বারা ক্ষতস্থান অসাড় করিয়া ফেলিলে অস্ত্রোপচারের পর যেরূপ হয়, সেইরূপ কোন বেদনা অনুভূত হইত না। সকল জিনিস তন্নতন্নভাবে লক্ষ্য করিবার শক্তিও ছিল তাহার অসাধারণ। শারীরিক গঠনের খুঁটিনাটিও তাহার নিকট অর্থপূর্ণ বলিয়া বোধ হইত, এবং উহার মধ্যে তিনি ব্যক্তির চরিত্র সম্বন্ধে কিছু না কিছু পরিচয় পাইতেন। নবাগত শিষ্যকে তিনি একরূপ যোগনিদ্রায় অভিভূত করিয়া তাহার মগ্নচৈতন্য হইতে, কয়েক মিনিটের মধ্যে বহু অতীতের যে-সকল সংস্কার নিহিত আছে, তাহা জানিয়া লইতেন, অপরের নিকট তুচ্ছ বলিয়া প্রতীত হয় এরূপ প্রত্যেক সামান্য কথা ও কার্য তাহার নিকট চরিত্ররূপ মহাপ্রবাহে নীত তৃণখণ্ডের ন্যায় ঐ স্রোতের গতি নির্দেশ করিয়া দিত। তিনি বলিতেন,”কখন কখনও এমন একটা অবস্থা হয়, যখন নবনারীকে কাচের জিনিসের মতো বোধ হয়, এবং তাদের ভেতর-বার সব দেখতে পাই।”
সর্বোপরি, স্পর্শমাত্র তিনি লোকের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিয়া দিতে পারিতেন, এবং তাহাদের সমগ্র জীবন এক নূতন শক্তিপ্রভাবে গঠিত ও পরিচালিত হইত; সমাধিবিষয়ে একথা সকলেই জ্ঞাত আছেন, বিশেষতঃ যে-সকল স্ত্রীলোক দক্ষিণেশ্বর দর্শন করিতে যাইতেন, তাহাদের সম্পর্কে। কিন্তু ইহা ব্যতীত একজন অতি সাদাসিধা প্রকৃতির লোক আমাকে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ কয়মাসের একদিনের এক ঘটনার কথা বলেন। ঐদিন কাশীপুর উদ্যানে বেড়াইতে বেড়াইতে তিনি সমবেত ভক্তদের মাথায় হাত দিয়া কাহাকেও বলেন, “চৈতন্য হোক, আর কাহাকেও বলেন, “আজ থাক’; এইভাবে সকলকে কিছু না কিছু বলেন। ইহার পরেই কৃপাপ্রাপ্ত ভক্তদের প্রত্যেকের বিভিন্ন প্রকারের অনুভূতি হয়। একজনের মনে অত্যন্ত বেদনা জাগিয়া ওঠে; অপর একজনের নিকট চারিপাশের সকল জিনিস ছায়ার ন্যায় অবাস্তব ও কোন একটি ভাবের ব্যঞ্জকমাত্র হইয়া ওঠে। তৃতীয় ব্যক্তি ঐ কৃপা অপার আনন্দরূপে অনুভব করেন। আর একজনের মহান জ্যোতি দর্শন হয়, যাহা তাহাকে কদাপি পরিত্যাগ করে নাই; কোন মন্দিরে অথবা পথিপাশ্বস্থ দেবালয়ের নিকট দিয়া যাইবার সময় তিনি সর্বদা ঐ জ্যোতি দেখিতে পাইতেন, এবং বোধ হইত ঐ জ্যোতির মধ্যে তিনি একটি মূর্তি দেখিতে পাইতেছেন; সেই মুহূর্তে তিনি যেরূপ দর্শনের উপযুক্ত হইতেন সেই অনুসারে, ঐ মূর্তি কখনও হাস্যময়, কখনও বিষণ্ণ। ‘বিগ্রহের অধিষ্ঠাতা চৈতন্য’ বলিয়াই তিনি ঐ মূর্তিকে জানিতেন এবং সেইরূপভাবে তাহার সম্বন্ধে বলিতেন।
এইরূপে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে তাহার অন্তর্নিহিত শ্রেষ্ঠ ও সার বস্তুর উদ্বোধন করিয়া দিয়া, অথবা যিনি যে পরিমাণে গ্রহণের উপযুক্ত হইতেন, সেই অনুসারে নিজের অনুভূতি তাহাদের মধ্যে সঞ্চারিত করিয়া দিয়া, শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কঠোর সত্যপরায়ণতা এবং প্রবল বিচারবুদ্ধির সূত্রপাত ও সংরক্ষণ করিয়া যান, যাহা তাহার হাতে গড়া সকল শিষ্যের মধ্যেই আমরা দেখিতে পাই। তাঁহাদের মধ্যে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামে একজন বলেন, “কোন কিছু পরীক্ষা না করে আমরা বিশ্বাস করি না, ঠাকুর আমাদের ঐরকমভাবে শিক্ষা দিয়েছেন।” আর একজনের নিকট ঐ শিক্ষা কিরূপ বিশেষ আকার ধারণ করিয়াছিল এই সম্পর্কে অনুসন্ধান করায় গভীর চিন্তার পর তিনি উত্তর দেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদের সেই চরম সত্তার কিছু না কিছু অনুভূতি করাইয়া দিতেন; তাহা হইতে প্রত্যেকে এমন একটি জ্ঞান লাভ করিতেন, যাহা কখনও প্রতারণা করিবে না। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার প্রথম বয়সের বক্তৃতাগুলির একটিতে বলিয়াছেন, “আমাদের নিজের চেষ্টায় অথবা কোন সিদ্ধ মহাপুরুষের কৃপায় আমরা সেই চরম বস্তু লাভ করি।”
গুরুর জীবনই শিষ্যের করতলগত সম্পদ, এবং এ বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই যে, মানবের মানসিক বৃত্তিসমূহের কতদূর সম্প্রসারণ ঘটিতে পারে, সে সম্পর্কে স্বামীজী নিজ দৃষ্ট ও অনুভূত সকল ঘটনা তৎক্ষণাৎ বিশ্লেষণ করিয়াছিলেন বলিয়াই, পাশ্চাত্যদেশের মনোরাজ্যবিষয়ক গবেষণার সংস্পর্শে আসিবামাত্র তিনি সমগ্র জ্ঞানকে অবচেতন (sub-conscious), সাধারণ বা চেতন (conscious) এবং অতিচেতন বা অতীন্দ্রিয় (superconscious)—এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিতে পারেন। প্রথম শব্দ দুইটি ইউরোপ এবং আমেরিকায় যথেষ্ট প্রচলিত ছিল, তৃতীয়টি তিনি নিপুণ সূক্ষ্মদৃষ্টি এবং নিজ জীবনের ব্যক্তিগত অনুভূতির বলে মনস্তত্ত্ববিষয়ক শব্দসমষ্টির অন্তর্ভুক্ত করিয়া দিলেন। একবার তিনি বলেন, “সাধারণ জ্ঞান অবচেতন ও অতিচেতন (অথবা অতীন্দ্রিয়) জ্ঞানরূপ দুই মহাসমুদ্রের মধ্যে অবস্থিত একটা সামান্য পাতলা পর্দামাত্র।” তিনি সবিস্ময়ে আরও বলেন, “যখন আমি পাশ্চাত্য জাতিদের সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে এত বড়াই করতে শুনলাম, তখন আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। সাধারণ জ্ঞান? সাধারণ জ্ঞানে কি আসে যায়? তার নিচে অতলস্পর্শ সাগরের মতো যে মগ্নচৈতন্য এবং উপরে যে পর্বততুল্য উচ্চ অতীন্দ্রিয় জ্ঞান রয়েছে, তাদের তুলনায় সাধারণ জ্ঞান কিছুই নয়! এ সম্পর্কে আমার ভুল হবার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ, আমি কি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে দশ মিনিটের মধ্যে লোকের মগ্নচৈতন্য থেকে তার সমগ্র অতীত জেনে নিতে এবং তা থেকে তার ভবিষ্যৎ এবং অন্তরের শক্তি নিরূপণ করতে দেখিনি?”