ভারতবর্ষে এইরূপে সঞ্চিত ও অদ্ভুতভাবে প্রসার লাভ করিয়াছে যে জ্ঞানরাজ্য, তাহার মধ্যে মনোরাজ্যের এমন অনেক ঘটনার যথোচিত সমাবেশ ও শ্রেণীবিন্যাস যে থাকিবে, তাহা অপেক্ষাকৃত অল্প-অভিজ্ঞ পাশ্চাত্যবাসীর নিকট অস্বাভাবিক বা অলৌকিক বলিয়া বোধ হয়—ইহা কিছু বিচিত্র নয়। সুতরাং সম্মোহনী বিদ্যা এবং দুর্বোধ্য বহুপ্রকারের অসাধারণ অনুভব বা শক্তি–যেমন রোগ আরোগ্য করা, মনের কথা বলিয়া দেওয়া, দূরদর্শন এবং দুরশ্রবণ ইত্যাদি যাহা সাধারণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরিচিত—যাহারা ভারতের প্রাচীন মনস্তত্ত্ব বা রাজযোগের আলোচনা করিয়াছেন, তাহাদের নিকট একটা মস্ত কঠিন ব্যাপার বলিয়া বোধ হয় না।
আমরা সকলেই অবগত আছি যে, বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার প্রধান মূল্য এই যে, উহা আমাদের নানা ঘটনা বুঝিতে ও লিপিবদ্ধ করিতে সাহায্য করে। কোন একটি ব্যাধি বিরল হইলে কিছু ক্ষতি নাই—যদি সমগ্র চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যে কোথাও একবার মাত্র উহার উল্লেখ থাকে। তাহা হইলেই মানবমনে উত্মার স্থান রহিয়া গেল। উহা আর অলৌকিক ব্যাপার নহে, কারণ শীঘ্র অথবা বিলম্বে উহার শ্রেণীনির্দেশ হইবেই। উহার একটি নাম আছে; রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা এখন শুধু সময়সাপেক্ষ।
সচরাচর যাহাকে ‘অলৌকিক’ দর্শনাদি বলিয়া অভিহিত করা হয়, সেই সকল ঘটনার যে অংশ বিশ্বাসযোগ্য, তাহার সম্পর্কে পূর্বোক্ত কথা কিছুটা প্রয়োগ করা চলে। এই পর্যায়ভুক্ত ঘটনাবলী সত্য হইলে স্পষ্টতই উহা বায়ুর তরলীকরণ বা রেডিয়ম পৃথককরণ অপেক্ষা বেশি অলৌকিক থাকে না। বাস্তবিক, ‘অলৌকিক’ বা ‘অতিপ্রাকৃত’ কথাটি আদৌ সঙ্গত কিনা তাহা বিতর্কমূলক। কারণ, যদি কোন জিনিসের অস্তিত্ব একবার প্রমাণ করা যায়, তাহা হইলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, উহা প্রকৃতির অন্তর্গত, এবং সেজন্য উহাকে “অতিপ্রাকৃত’ বলা নিতান্ত অযৌক্তিক। ভারতবর্ষে আলোচ্য ঘটনাসমূহ মনোবৃত্তির সমধিক বিকাশের ফল বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে; এবং ঘটনার মধ্যে উহাদের ব্যাখ্যা আবিষ্কার করিবার চেষ্টা না করিয়া, যে ব্যক্তি ঐ-সকল উপলব্ধি করিয়াছে তাহার মনের অবস্থার অনুসন্ধান করা হইয়া থাকে; কারণ, ইহা সহজেই অনুমেয় যে, ঐ মন বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সাধারণ অনুভব হইতে পৃথক এক এক রূপ অনুভূতি লাভ করিতে পারে।
চিত্তের চরম একাগ্রতার যে-সকল লক্ষণ শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের দক্ষিণেশ্বরে বাসকালে বহু বৎসর ধরিয়া তাহার শিষ্যগণ তাহার মধ্যে ঐ সকল মানসিক বিকাশের বহু ঘটনার পরিচয় পান। বাহ্যজগতের ঘটনাসমূহ তিনি এমন জানিতে পারিতেন যে, তাহারা দ্বারদেশে উপনীত হইবামাত্র তিনি স্বয়ং অগ্রসর হইয়া তাহাদের সহিত সাক্ষাৎকরিতেন, এবং বালকেরা যে-সব লিখিত প্রশ্ন পকেটে করিয়া আনিতেন, জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাদের উত্তর দিতে প্রবৃত্ত হইতেন। তাহার অনুভূতি এত সূক্ষ্ম ছিল যে, তিনি স্পর্শমাত্র বলিয়া দিতে পারিতেন, কিরূপ চরিত্রের লোক তাহার খাদ্যসামগ্রী, কাপড়-জামা অথবা বিছানা স্পর্শ করিয়াছে। একবার ঐরূপ স্পর্শ করিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার অঙ্গ যন্ত্রণায় সঙ্কুচিত হইয়া সরিয়া আসে এবং তিনি বলিয়া ওঠেন যে, তিনি দাহ যন্ত্রণা অনুভব করিতেছেন। আর এক ঘটনায় হয়তো বলিলেন, “এই দেখ! এটা আমি খেতে পারি; যে পাঠিয়েছে, সে নিশ্চয়ই ভাল লোক।” আবার তাহার স্নায়ুমণ্ডলীতে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ ভাবের এরূপ দৃঢ় সংস্কার জন্মিয়াছিল যে, নিদ্রিত অবস্থাতেও তিনি ধাতুদ্রব্য স্পর্শ করিতে পারিতেন না, এবং কোন পুস্তক বা ফল উহার মালিকের নিকট প্রত্যর্পণ করিতে ভুলিয়া গেলে তাঁহার হাত যেন আপনা হইতেই উহা যথাস্থানে ফিরাইয়া দিয়া আসিত।
কোন ভারতীয় মনস্তত্ত্ববিদ জগতের ক্রান্তদর্শী মহাপুরুষগণের কাহারও সম্বন্ধে একথা বলিবেন না যে, উক্ত মহাপুরুষ দেবতাদের সহিত কথাবার্তা বলিয়াছেন; তাহারা শুধু বলিবেন যে, তিনি এমন একটি মানসিক ভাবাবস্থায় উপনীত হইতে পারেন, যেখানে তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস হইতে পারে, তিনি দেবতাদের সহিত কথা কহিয়াছেন, অর্থাৎ ভারতীয় দার্শনিকের মতে উহা ‘স্বসংবেদ্য ব্যাপার। এই অবস্থার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ দেখিয়াছেন। তাঁহারা এখনও গল্প করিয়া থাকেন, কিরূপ বিস্ময়ের সহিত তাহারা কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া দুইজন অথবা বহুজনের মধ্যে কথাবার্তা হইতেছে শুনিতেন—তাহার মধ্যে এক পক্ষের কথাগুলিই শুধু তাহাদের কানে আসিতেছে; এদিকে তাহাদের গুরুদেব শান্তভাবে বিশ্রাম করিতে করিতে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করিতেন যে, শিষ্যগণের অদৃশ্য দেবদেবীর সহিত ধ্যানযোগে তিনি কথাবার্তা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের এই সকল অজস্র দর্শনের পশ্চাতে সর্বদাই ছিল মানবসেবার দৃঢ় সঙ্কল্প। উহাই এই সকলকে এক মহাজীবনরূপে গ্রথিত করিয়াছিল। বহুকাল পরে স্বামী বিবেকানন্দ তাহার গুরুদেব সম্বন্ধে বলিতেন, রাত্রির অন্ধকারে মাটিতে পড়িয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে তিনি প্রার্থনা করিতেন, আবার যেন তিনি পৃথিবীতে এমন কি, কুকুরযোনিতেও জন্মগ্রহণ করেন, যদি তাহা দ্বারা একটি জীবেরও সহায়তা হয়। অন্যান্য সময়ে যখন মনের কথা অপরের নিকট ব্যক্ত করিতে পারিতেন, তখন তিনি বলিতেন, উচ্চতর দর্শন তাহাকে সেবার ভাব হইতে টানিয়া লইবার জন্য প্রলোভিত করিতেছে। গভীর সমাধিভঙ্গের পর তিনি যে দুই-চারিটি কথা, আপন মনে বলিতেন, তাহার শিষ্যগণ তাহা ঐ বিষয়ক বলিয়াই মনে করিতেন। তিনি যেন শিশুর ন্যায় মাতার নিকট হইতে দৌড়িয়া গিয়া খেলিবার জন্য জগন্মাতার নিকট আব্দার করিতেন। এরূপ ক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞানভূমিতে নামিয়া আসিবার জন্য তিনি, “আর একটি মাত্র সেবাকাজ’, অথবা ‘আর একটি ছোটখাট জিনিস’ ভোগ করিব, এই বলিয়া বায়না ধরিতেন। কিন্তু সমাধি হইতে ঐ বুত্থানকালে ঈশ্বরে একান্ত তন্ময়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ন্যায় তাহাতে সর্বদা অনন্ত প্রেম ও গভীর অন্তদৃষ্টি পরিলক্ষিত হইত। হার্ভার্ড বক্তৃতা উপলক্ষে স্বামী বিবেকানন্দ যখন ঐ দুইটিকেই সমাধিজনিত বাহ্যজ্ঞানশূন্যতা ও মৃগীরোগহেতু বাহ্যজ্ঞানশূনতা, এই উভয়ের মধ্যে লক্ষণের পার্থক্য বলিয়া নির্দেশ করেন, তখন আমরা বুঝিতে পারি তাহার গুরুদেবের জীবনে সমাধি অবস্থা লাভ ও পুনরায় ঐ অবস্থা হইতে সাধারণ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন—এই উভয় অবস্থা তিনি সর্বদা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন বলিয়াই তাহার প্রত্যেক কথার মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় বিরাজ করিত।