কিন্তু তাহার এই কঠোর সমালোচনা কোন শুষ্ক দোষদর্শীর মত ছিল না। যাহারা আমাদের গুরুদেবের ‘ভক্তিযোগ পাঠ করিয়াছেন, তাহাদের এই বিশেষ উক্তিটি মনে পড়িবে, “প্রেমিক প্রেমাস্পদের মধ্যে আদর্শকেই দেখে।” এক বালিকার একজনের প্রতি অনুরাগের কথা তখন সবেমাত্র জানা গিয়াছে। স্বামীজী তাহাকে বলেন, “যতদিন তোমরা দুজনে পরস্পরের মধ্যে আদর্শকেই দেখতে পাবে, ততদিন তোমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সুখ না কমে বেড়েই যাবে।”
আমাদের গুরুদেবের বিশেষ পরিচিত ব্যক্তিগণের মধ্যে এক প্রৌঢ়া মহিলার কিন্তু এই বিশ্বাস ছিল যে, সন্ন্যাসধর্মের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠাবশতঃ বিবাহিতজীবনের পবিত্রতা ও উপকারিতা স্বামীজী যথার্থ বিচার করিতে পারেন নাই। উক্ত মহিলা বিবাহিত জীবনে অসাধারণ সুখভোগের পর দীর্ঘকাল বৈধব্যজীবন যাপন করিতেছিলেন। সুতরাং ইহা নিতান্ত স্বাভাবিক যে, দেহাবসানের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে স্বামীজী এই বিষয়ে যে চূড়ান্ত মীমাংসায় উপনীত হন, তাহা এই মহিলাকে জ্ঞাপন করিতে চাহিবেন। যে পত্রবাহক তাহার পত্রখানি মহিলার বহুদূরে অবস্থিত গৃহে পৌঁছাইয়া দিল, সে-ই স্বামীজীর দেহত্যাগের সংবাদসহ প্রেরিত তারও ঐসঙ্গে তাঁহার হাতে দেয়। কে জানিত, পত্রখানি এরূপ দারুণ শোকের সময় যাইয়া উপস্থিত হইবে? ঐ পত্রে, স্বামীজী লেখেন, “আমার মতে কোন জাতিকে ব্রহ্মচর্যের আদর্শে উপনীত হইবার পূর্বে বিবাহবন্ধনকে পবিত্র ও অচ্ছেদ্য জ্ঞান করিয়া তাহার মাধ্যমে মাতৃভাবের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাভাবের অনুশীলন করিতে হইবে। রোমান ক্যাথলিক ও হিন্দুগণ বিবাহবন্ধনকে পবিত্র ও অচ্ছেদ্য জ্ঞান করিয়া প্রভূত শক্তিশালী মহাশুদ্ধসত্ত্ব পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করিয়াছে। আরবদিগের নিকট বিবাহ একটা চুক্তিবদ্ধ অঙ্গীকার মাত্র, অথবা বলপূর্বক অধিকার, যাহা ইচ্ছামাত্র বিচ্ছিন্ন করা যায়। ফলে আমরা সেখানে চিরকুমারী অথবা ব্রহ্মচারীর আদর্শের বিকাশ দেখিতে পাই না। যে-সকল জাতি এখনও বিবাহবন্ধনের মাহাত্ম্য বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই, তাদের হাতে পড়িয়া আধুনিক বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসকে অতি বিকৃত কদাচারপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। সুতরাং জাপানে যতদিন বিবাহ-সম্বন্ধে পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ ও প্রণয় ব্যতীত একটা মহান ও পবিত্র আদর্শের বিকাশ না ঘটে, ততদিন কিরূপে উচ্চস্তরের সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর সৃষ্টি হইবে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না। আপনি যেমন ক্রমশঃ বুঝিতে পারিয়াছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধটি পবিত্র ও অক্ষুণ্ণ রাখাই জীবনের গৌরব, সেইরূপ আমিও ক্রমশঃ এই জ্ঞান লাভ করিয়াছি যে, জগতের অধিকাংশ লোকের পক্ষেই এই মহাপবিত্র বন্ধনের বিশেষ প্রয়োজন; তাহা হইলেই কয়েকজন শক্তিশালী, আজীবন ব্রহ্মচর্যব্রতী পুরুষ ও নারীর উদ্ভব হইতে পারে।”
আমাদের মধ্যে কেহ কেহ মনে করেন, এই পত্রখানিতে স্বামীজী স্বয়ং যতটা অর্থপ্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া মনে করিতে পারিতেন, তাহা অপেক্ষা ব্যাপকতর অর্থ নিহিত আছে। ইহাই সেই মহান দর্শনের শেষ কথা, “বহু এবং একের মধ্যে সেই একই সত্য বিরাজমান।” যদি দাম্পত্যবন্ধনকে পবিত্র ও অচ্ছেদ্য জ্ঞান করাই বস্তুতঃ সমাজকে এরূপভাবে গঠিত করার সোপানস্বরূপ হয়, যাহাতে নির্জনবাস ও সংযমপূর্ণ সন্ন্যাসজীবনের সর্বোচ্চ সম্ভাবনা দেখা যায়, তাহা হইলে যথোচিত শ্রদ্ধার সহিত সাংসারিক কর্তব্যগুলির অনুষ্ঠান, পূজা এবং প্রার্থনাদির ন্যায় আত্মসাক্ষাৎকারের অন্যতম উপায়স্বরূপ বলিয়াই গৃহীত হইবে। সুতরাং এখানে আমরা একটি সাধারণ নিয়মের পরিচয় পাই যাহাতে আমরা বুঝিতে পারি, কেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ভাবসমাধি প্রভৃতি ধর্মজীবনের উচ্ছাসকে প্রশংসা না করিয়া বরং তাঁহার শিষ্যগণের মধ্যে চরিত্রের দৃঢ়তা বিকাশের সমধিক পক্ষপাতী ছিলেন। আবার স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও যে কেন সর্বদা সকলকে বীর্যবান হইবার জন্য উৎসাহিত করিতেন, তার অন্তর্নিহিত অর্থও আমরা বুঝিতে পারি। উহার কারণ নির্ণয় অতি সহজ। যদি “বহু ও এক, একই মন কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় দৃষ্ট একমাত্র সত্তা” হয়, তাহা হইলে এক কথায় বলা যায়, চরিত্রই ধর্ম। জনৈক গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি যেমন বলিয়াছেন, “প্রকৃতপক্ষে জগতের সাধারণ জিনিসগুলি গ্রহণ করিয়া ঠিক ঠিক ভাবে তাহাদের মধ্যে চলাফেবা করাই মহত্ত্ব, এবং গভীর প্রেম ও প্রভূত সেবাই সাধুতা।” এই সহজ কথাগুলিই হয়তো অবশেষে এযুগের নব ধর্মবাণীর প্রাণস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইবে। ইহা যে সম্ভবপর, আমাদের গুরুদেবের নিজ কথাগুলিই তাহার নিদর্শন, “সর্বোচ্চ সত্য সকল সময়েই অতি সহজ।”
———–
১ সতীত্ব বলিতে হিন্দুগণের ধারণা এই যে, স্বামীর প্রতি পত্নীর কেবল অবিচলিত নিষ্ঠা নহে, ঐ নিষ্ঠার কদাপি লেশমাত্র ইতরবিশেষ ঘটিবেনা। এই আদর্শ আমার ভাল লাগে না বলিয়া ঐ নিষ্ঠার কোনরূপ বিচ্যুতি ঘটিবার উপায় নাই।
২৩. তথাকথিত অলৌকিক দর্শনাদির সহিত আচার্যদেবের সম্বন্ধ
ভারতবর্ষই নিঃসন্দেহে মনস্তত্ত্ব-চর্চার প্রকৃষ্ট স্থান। একথা বলা চলে যে, জগতের অন্য যে কোন জাতি অপেক্ষা হিন্দুদিগের নিকটই মানুষ অধিক পরিমাণে মন-রূপে প্রতিভাত হয়। চিত্তের একাগ্রতা তাদের নিকট জীবনের আদর্শ বলিয়া পরিগণিত। ধীশক্তি ও প্রতিভা, সাধারণ সততা ও সর্বোচ্চ সাধুজীবন, নৈতিক দুর্বলতা ও শক্তিমত্তা—এই সকলের মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তাহা একাগ্রতার সামান্য তারতম্য হইতেই উদ্ভূত বলিয়া তাহারা মনে করে। অতি প্রাচীনকাল হইতেই ভারতে মনস্তত্ত্ব-চর্চা একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের মতো যথোচিতভাবে অধীত হইয়া আসিয়াছে; বস্তুতঃ উহাই কতকাংশে হিন্দুজাতির এই তন্ময়তার কারণ, আবার কতকাংশে তাহার ফলও বটে। জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য লিখন-প্রণালীর উপকারিতা কিছুমাত্র অনুমান করিবার বহুপূর্বে, হিন্দুসমাজে সমষ্টি মানবমনের যাবতীয় ব্যাপার পরস্পরের মধ্যে চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের আদান-প্রদান দ্বারা নিঃশব্দে সংগৃহীত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সহিত সাধারণভাবে যন্ত্রপাতি ও রসায়নাগারের আদৌ কোন সম্পর্ক থাকিতে পারে, এই চিন্তা উদিত হইবার বহু যুগ পূর্বে, ভারতবাসীর মধ্যে তাহাদের প্রকৃতির সর্বাপেক্ষা অনুকূল এই বিজ্ঞান সম্পর্কে পরীক্ষার যুগ পূর্ণভাবে বিকশিত হয়।