কিন্তু তাহার মতে কোন সামাজিক আদর্শকে অনর্থক বাড়াইয়া তোলার মধ্যে সমাজের গণ্ডির বাহিরে অবস্থিত যে মহান আদর্শ, তাহার চিরন্তন মাহাত্ম্যকে লাঘব করারূপ অশেষ বিপদের সম্ভাবনা আছে। জনৈক শিষ্যকে একবার তিনি গম্ভীরকণ্ঠে বলেন, “তুমি যাদের শিক্ষা দেবে, তাদের প্রত্যেককে একথা বলতে কখনো ভুলো না–
‘মেরুসষপয়োর্য যৎ সূর্যখদ্যোতয়োরিব।
সরিৎসাগরয়োযৎ তথা ভিক্ষুগৃহস্থয়োঃ ॥
—মেরু ও সর্ষপে, সূর্য ও খদ্যোতে, সমুদ্র ও গোষ্পদে যে প্রভেদ, সন্ন্যাসী এবং গৃহীর মধ্যেও সেইরূপ প্রভেদ।”
তিনি জানিতেন যে, ইহার মধ্যে আধ্যাত্মিক গর্বরূপ বিপদের আশঙ্কা রহিয়াছে। তাহার নিজের পক্ষে এই বিপদ অতিক্রম করার উপায় ছিল এই যে, তিনি স্বয়ং তাহার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য ও ভক্তমাত্রের নিকটেই তিনি গৃহী বা সন্ন্যাসী হউন—মস্তক নত করিতেন। কিন্তু উক্ত অনুশাসনবাক্যের মর্যাদা হ্রাস করার অর্থ তাহার দৃষ্টিতে আদর্শ খর্ব করা; উহা তিনি কোনমতেই করিতে পারিতেন না। বরং তিনি অনুভব করিতেন, বর্তমান যুগে সন্ন্যাসিসঙ্ঘের উপর ন্যস্ত অন্যতম মহান গুরুতর দায়িত্ব হইল, বিবাহিত জীবনেও সন্ন্যাসের আদর্শ প্রচার করা; উদ্দেশ্য, যাহাতে কঠিনতর পথটি অপেক্ষাকৃত সহজ পথের উপর সর্বদা স্বীয় সংযমশক্তির প্রভাব প্রয়োগ করিতে পারে; এবং প্রণয়ের আপাতমধুর যে মোহজাল যাহা হৃদয়-মনের একান্ত প্রীতিকর জীবনসঙ্গী অথবা সঙ্গিনীলাভের দোহাই দিয়া মানবজীবনের চরম লক্ষ্য আত্মার অদ্বিতীয় মহিমা ও স্বাধীনতা ঢাকিয়া ফেলিতে চায়—তাহা একেবারে ছিন্ন ও বিনষ্ট হইয়া যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণের সকল শিষ্যই বিশ্বাস করেন যে, বিবাহের চরম পরিণতি নিজ পত্নীতে মাতৃবুদ্ধি; ইহার অর্থ স্বামী-স্ত্রী উভয় কর্তৃক ব্রহ্মচর্য জীবন গ্রহণ।সেই মুহূর্ত হইতে মানব দেবত্বে লীন হয়, যার ফলে সমগ্র জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে। পণ্ডিতেরা বলেন, মনস্তত্ত্বের দিক দিয়া দেখিলে এই আদর্শের যথার্থতা এইরূপে প্রমাণিত হয় যে, ঐ চরম অবস্থায় উপনীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিবাহসম্বন্ধের মধ্যে ভালবাসার বৃদ্ধি এবং হ্রস—ক্রমাগত প্রবৃত্তির জোয়ার-ভাটা চলিতে থাকে। বাহ্যসম্বন্ধ পরিত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু প্রকৃতির হাত হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, এবং তখন আর প্রেমের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে না। এখন হইতে পূর্ণ নিষ্ঠার সহিত মন প্রেমাস্পদকে পূজা করিয়া থাকে।
তথাপি এই বিষয়ে তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করিতে গিয়া হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে পার্থক্য সম্বন্ধে কাশ্মীরে একদিন তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা মনে না করিয়া পারিতেছি না। সেদিন রবিবার, প্রাতঃকাল; উভয় পার্শ্বে সারি সারি পপলার বৃক্ষের মধ্য দিয়া চওড়া রাস্তা চলিয়া গিয়াছে; বেড়াইতে বেড়াইতে তিনি নারীজাতি ও জাতিভেদ সম্পর্কে কথা বলিতে লাগিলেন, আমরাও মন দিয়া শুনিতেছি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলিলেন, “হিন্দুধর্মের মহিমা এই যে, এর মধ্যে বিভিন্ন আদর্শের নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু হিন্দুধর্ম কখনই একথা বলতে সাহস করেনি যে,ঐসব আদর্শের কোন একটিই একমাত্র সত্য পথ। এখানেই বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তার প্রভেদ। বৌদ্ধধর্ম অন্য সকল আদর্শের ওপর স্থান দিয়েছে সন্ন্যাসকে, এবং তার মতে সন্ন্যাস হলো সকল মুমুক্ষুর সিদ্ধিলাভের একমাত্র পথ। মহাভারতে এক যুবক সাধুর গল্প আছে; জ্ঞানলাভের জন্য তিনি প্রথমে এক বিবাহিতা নারী এবং পরে এক মাংসবিক্রেতার কাছে যেতে উপদেশ পান। এই গল্পটিই পূর্বের কথার সত্যতার যথেষ্ট প্রমাণ। জিজ্ঞাসার উত্তরে পতিব্রতা এবং ব্যাধ দুজনেই বলেছিলেন, বর্ণাশ্রমধর্ম পালন করেই আমরা এই জ্ঞানলাভ করেছি।” উপসংহারে স্বামীজী বলেন, “দেখছ, এমন কোন জীবিকা নেই, যার দ্বারা ভগবানের কাছে যাওয়া না যায়, তাকে লাভ করা শেষ পর্যন্ত কেবল প্রাণের ব্যাকুলতার উপর নির্ভর করে।”
জীবনে আদর্শ পবিত্রতার প্রকাশ অনুযায়ী সকল জীবনের মহত্ত্ব নির্ধারণ করিতে হয়, এই বিষয়টি মতবাদ হিসাবে স্বামীজী সত্য বলিয়াই গ্রহণ করিতেন। কিন্তু উহার কদৰ্থ করিয়া যে মিথ্যা দাবি করা হইয়া থাকে যে, বিবাহ শুধু ধর্মলাভের উদ্দেশ্যেই অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সাধু হিসাবে স্বামীজী এই সকল উক্তি বিষবৎ জ্ঞান করিতেন। তিনি বেশ জানিতেন, আত্মগরিমাবশতঃ আমরা সর্বদাই নিজ নিজ কার্য ও উদ্দেশ্য ঐরূপ অজ্ঞাতসারে বাড়াইয়া তুলি। তিনি আমাদের বলিয়াছিলেন যে, পাশ্চাত্যদেশে প্রায়ই এমন ব্যক্তির সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইত, যাহারা বিলাসের মধ্যে অলসভাবে জীবনযাপন করিলেও বুঝাইতে চেষ্টা করিত যে, তাহাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বার্থপরতা নাই, কেবল কর্তব্যের খাতিরেই তাহারা সংসারে রহিয়াছে; এবং নানাপ্রকার ভালবাসার মধ্য দিয়া বিনা প্রচেষ্টায় আপনা হইতে ত্যাগ অভ্যাসে সমর্থ হইয়াছে। অত্যন্ত ঘৃণার সহিত তিনি এই সকল অলীক কল্পনার প্রতিবাদ করিতেন। তিনি বলেন, “আমার কেবল এই উত্তর ছিল যে, এই ধরনের মহাপুরুষ তত ভারতবর্ষে জন্মান না! মহাত্মা জনক রাজাই ছিলেন এরকম আদর্শ পুরুষ, এবং সমগ্র ইতিহাসে জনক রাজা মাত্র একবারই জন্মেছেন!” এই বিশেষ ভ্রম সম্পর্কে তিনি দেখাইয়া দিতেন যে, দুই প্রকার আদর্শবাদ (Idealism) আছে, একটি–যথার্থ আদর্শকেই পূজা ও উচ্চাসন প্রদান করা; অপরটি—আমরা নিজে যে অবস্থা লাভ করিয়াছি, তাহাকেই বাড়াইয়া স্বর্গে তোলা। শেষোক্ত ক্ষেত্রে আদর্শকে প্রকৃতপক্ষে আমাদের ‘অহং’-জ্ঞানেরই নিম্নে আসন দেওয়া হয়।