তথাপি কাহারও পক্ষে বিবাহ যে একটি পথ, ইহা তিনি একেবারে বুঝিতেন না, তাহা নহে। এক বৃদ্ধদম্পতির যে গল্প তিনি বলিয়াছেন, তাহা আমি কখনও ভুলিব না। পঞ্চাশ বৎসর একত্র বাসের পর তাহারা দরিদ্র-নিবাসের (Work house) দরজায় পরস্পরের নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হয়। প্রথম দিনের অবসানে বৃদ্ধ বলিয়া উঠিল, “কি! মেরী, ঘুমোত যাবার আগে আমি তাকে একবার দেখতে পাব না, চুমু খেতে পাব না? আমি যে পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতি রাত্রে ঐরকম করে এসেছি।” ঐ মহৎ কার্যের কথা ভাবিয়া আগ্রহের সহিত স্বামীজী বলিলেন, “একবার ভেবে দেখ! এরূপ সংযম ও নিষ্ঠার নামই মুক্তি! ঐ দু-জনের পক্ষে বিবাহই ছিল প্রশস্ত পথ।”
তিনি অবিচলিত দৃঢ়তার সহিত বলিতেন, ইচ্ছা না থাকিলে বিবাহ না করার স্বাধীনতা প্রত্যেক নারীর স্বাভাবিক অধিকার বলিয়া গণ্য হওয়া উচিত। এক বালিকার দ্বাদশবর্ষ বয়সের পূর্বেই ধর্মজীবনের প্রতি প্রবল অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। বাড়ির লোকদের বিবাহ-প্রস্তাবের হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য বালিকাটি তাহার সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনিও বালিকার পিতার উপর নিজের প্রভাব থাকায় এবং ঐরূপ করিলে কনিষ্ঠ কন্যাদের জন্য অধিক যৌতুকের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন একথা বুঝাইয়া বালিকাকে সাহায্য করিতে সমর্থ হন। বহু বত্সর অতীত হইয়াছে, কিন্তু বালিকা যে জীবন গ্রহণ করিয়াছিল তাহার প্রতি এখনও তেমন নিষ্ঠা রহিয়াছে—প্রত্যহ দীর্ঘকাল ধরিয়া নির্জনে ধ্যান-চিন্তা তাহার ঐ জীবনের অঙ্গস্বরূপ। তাহার কনিষ্ঠা ভগিনীগণ সকলেই বর্তমানে বিবাহিতা। এইরূপ উচ্চভাবসম্পন্ন কোন বালিকার জোর করিয়া বিবাহ দেওয়া তাহার দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত আচরণ বলিয়া বোধ হইত। বালবিধবা, কুলীন ব্রাহ্মণ-পত্নী, যাহাদের বিবাহকালে পিতামাতা কোনরূপ যৌতুক প্রদানে সমর্থ হন নাই, এমন দুই-চারিজনকে স্বামীজী গর্বের সহিত হিন্দুসমাজের অবিবাহিতা নারী অথবা কুমারীস্থানীয় বলিয়া গণনা করিতেন।
তিনি এই অভিমত পোষণ করিতেন যে, বিধবাদের সতীত্বরূপ স্তম্ভের উপরেই সামাজিক অনুষ্ঠানগুলি দণ্ডায়মান। কেবল তিনি ঘোষণা করিতে চাহিতেন যে, এই বিষয়ে নারীর ন্যায় পুরুষের জন্যও সমান উচ্চাদর্শ থাকা উচিত। বিবাহ সম্পর্কে প্রাচীন আর্যপ্রথায় দেখা যায় যে, বিবাহকালে প্রজ্বলিত অগ্নি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে একত্র প্রত্যহ সকালে ও সন্ধ্যায় পূজা করিতেন। এই অনুষ্ঠান দ্বারা বুঝা যায় যে, স্বামী, স্ত্রী উভয়েরই আদর্শ ও দায়িত্ব সমান। মহর্ষি বাল্মীকির মহাকাব্যে সীতার যেমন রামের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠার বর্ণনা আছে, রামেরও সীতার প্রতি তদ্রুপ।
পৃথিবীর সর্বত্র বিবাহ-সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাগুলি স্বামীজীর অজ্ঞাত ছিল না। পাশ্চাত্যে এক বক্তৃতায় তিনি বিস্ময়ের সহিত বলেন, “এই সব মহিলা দুর্দমনীয়, যাদের মন থেকে সহ্য কর, ক্ষমা কর’ প্রভৃতি শব্দ চিরদিনের মতো চলে গেছে।” তিনি ইহাও স্বীকার করিতেন, যেখানে বিবাহসম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার অর্থ মানবজাতির ভবিষ্যতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, সেক্ষেত্রে পরস্পরের সহিত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করা স্বামী, স্ত্রী উভয়ের পক্ষেই সর্বাপেক্ষা মহত্ত্ব ও সাহসের কার্য। তিনি সর্বদাই বলিতেন যে, ভারতবর্ষে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শসমূহের মধ্যে আদান-প্রদান দ্বারা উভয়কেই সতেজ করিয়া লওয়া আবশ্যক। অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তা না করিয়া তিনি কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের উপর দোষারোপ করিতেন না, এবং সর্বদা বলিতেন, ঐসকল অনুষ্ঠান এমন কোন অনাচার দূর করিবার প্রচেষ্টা হইতেই ক্রমশঃ উদ্ভূত হইয়াছে, যাহা সমালোচক মহাশয় খুব সম্ভবতঃ নিজের একগুয়েমিবশতঃ বুঝিতে অক্ষম। কিন্তু ঘড়ির দোলক কোন একদিকে অধিক ঝুঁকিয়া পড়িলে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা ধরিতে পারিতেন।
ভারতবর্ষে একদিন, পাত্রপাত্রীর নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিবাহের পরিবর্তে অভিভাবকগণের ব্যবস্থানুযায়ী হইয়া থাকে—এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওঃ! এদেশে কি কষ্ট, কি যন্ত্রণাই রয়েছে। তার কতকটা অবশ্য সব সময়ে ছিল। কিন্তু এখন ইউরোপীয় ও তাদের বিভিন্ন রীতিনীতি দেখে যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেছে। সমাজ জানতে পেরেছে যে, অন্য পথও একটা আছে।”
জনৈক ইউরোপবাসীকে তিনি আবার বলেন, “আমরা মাতৃভাবকে বাড়িয়ে তুলেছি, তোমরা জায়া ভাবকে; এবং আমার মনে হয়, একটু আদানপ্রদান উভয় পক্ষেই লাভকর।”
তারপর সেই স্বপ্নের কথা, যাহা তিনি জাহাজে আমাদের নিকট এইরূপে বর্ণনা করেন—’স্বপ্নে আমি দুজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম; তারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিবাহের আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করছে, এবং শেষে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয়ের মধ্যেই এমন কিছু অংশ আছে, যা এখনও জগতের পক্ষে হিতকর, অতএব বর্জন করা উচিত নয়। এই দৃঢ় বিশ্বাসহেতু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শগুলির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করিবার জন্য তিনি অত সময় অতিবাহিত করিতেন।
তিনি বলেন, “ভারতবর্ষে পত্নী স্বামীকে যেরূপ ভালবাসে, পুত্রকে পর্যন্ত স্বপ্নেও সেরূপ ভালবাসতে পারে না। তাকে সতী হতে হবে। কিন্তু স্বামী মাতাকে যত ভালবাসে, স্ত্রীকে তত ভালবাসতে পারবে না। সুতরাং ভারতবর্ষে পরম্পর আদান-প্রদানরূপ ভালবাসা প্রতিদানশূন্য ভালবাসার মতো উচ্চস্তরের বলে গণ্য হয় না। ওটা যেন দোকানদারি’। স্বামী-স্ত্রীর সব সময় পরস্পরের সান্নিধ্যলাভের আনন্দ ভারতবর্ষে উচিত বলে গ্রাহ্য হয় না। পাশ্চাত্যের কাছে এটা আমাদের নিতে হবে। আমাদের আদর্শকে তোমাদের আদর্শ দ্বারা একটু তাজা করে নিতে হবে। আর তোমাদের আমাদের মাতৃভক্তির খানিকটা নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাহার উপস্থিতিমাত্রেই লোকের মনে অপর সকল চিন্তা অভিভূত করিয়া এই ধারণা বলবতী হইত যে-যাহার উদ্দেশ্য কেবল আত্মার মুক্তি ও জগতের সেবা, গৃহসুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যপ্রয়াসী গার্হস্থ্যজীবন অপেক্ষা সেই সন্ন্যাসজীবন অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ। তিনি বিলক্ষণ জানিতেন যে, মহান শ্রেষ্ঠ কর্মিগণ মধ্যে মধ্যে পোষ্যবর্গের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকিবার প্রয়োজন অনুভব করেন। একবার জনৈক শিষ্যকে লক্ষ্য করিয়া তিনি অতি সস্নেহে ও সহৃদয়তার সহিত বলেন, “যদি এই সব গার্হস্থ্য ও দাম্পত্য জীবনের আকাঙক্ষা কখনো তোমার মনে ছায়া ফেলে, তার জন্য বিচলিত হয়ো না। আমার মনেও কখনো কখনো ঐ ধরনের চিন্তা আসে।” আর একবার জনৈক বন্ধুর মুখে, তিনি অত্যন্ত একাকী বোধ করিতেছেন শুনিয়া বলিয়া ওঠেন, “প্রত্যেক কর্মী সময়ে সময়ে ঐরূপ বোধ করে থাকে।”