যে অল্পপ্রাণ সাহিত্য ও আদর্শবিচ্যুত ললিতকলা মানবকে মুখ্যতঃ শরীর বলিয়া মনে করিয়া নিজ অধিকারে রাখিতে চায়, এবং সংযম ও স্বাধীনতার নিত্য লীলাভূমি মন ও আত্মাকে গৌণস্থান প্রদান করে তাহাদের স্বামীজী ভুলিয়াও প্রশংসা করিতেন না। সবটা না হইলেও আমাদের পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আদর্শবাদের (Idealism) অনেকটাই তাহার নিকট এই ভাব দ্বারা গভীরভাবে কলুষিত বলিয়া বোধ হইত, এবং উহার সম্পর্কে তিনি সর্বদা “ফুল দিয়ে মৃতদেহ ঢেকে রাখা” বলিয়া উল্লেখ করিতেন। প্রাচ্য ভাবানুযায়ী তিনি মনে করিতেন, আদর্শ পত্নীত্ব বলিতে বোঝায় এক স্বামীর প্রতি অবিচল জ্বলন্ত নিষ্ঠা। পাশ্চাত্যের প্রথাগুলিকে তিনি সম্ভবতঃ বহুপতিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করিয়া থাকিবেন, নতুবা বহুপতিক জাতির ভিতরও তাহার স্বদেশের ন্যায় মহানুভবা এবং পবিত্রস্বভাবা বহু নারী দেখিয়াছেন, তাহার এই উক্তির কোন কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তিনি মালাবারে ভ্রমণ করিয়াছেন, কিন্তু তিব্বতে নহে; এবং অনুসন্ধান দ্বারা জানিতে পারা যায় যে, মালাবারে তথাকথিত বহুপতিক প্রথা প্রকৃতপক্ষে মাতৃশাসিত সমাজের বিবাহমাত্র। স্বামী পত্নীর পিত্রালয়ে গিয়া তাহার সহিত দেখা সাক্ষাৎ করেন, এবং ভারতের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বিবাহ আজীবন স্থায়ী হইবেই, তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই; কিন্তু দুইজন পুরুষ এককালে স্বামী-রূপে গৃহীত হয় না। যাহা হউক, তিনি বলেন যে, তাহার এই শিক্ষা হইয়াছে যে, দেশাচার কিছুই নহে’—আচার ব্যবহার কখনও মানবের বিকাশসাধনে সম্পূর্ণরূপে বাধা দিতে বা সঙ্কুচিত করিতে পারে না। তিনি জানিতেন, যে-কোন দেশে, যে-কোন জাতির মধ্যে আদর্শটি বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির মধ্য দিয়াই পূর্ণভাবে প্রকাশ পাইতে পারে।
কোন সামাজিক আদর্শকে তিনি কখনও আক্রমণ করিতেন না। ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দে ইংলণ্ড প্রত্যাগমনকালে, সেখানে নামিবার দুই-একদিন পূর্বে তিনি আমাকে বলেন, পাশ্চাত্যদেশে অবস্থানকালে আমি যেন এমনভাবে ইউরোপের সামাজিক আদর্শগুলি পুনরায় গ্রহণ করি—যেন উহাদের কখনই পরিত্যাগ করি নাই। ইউরোপ বা আমেরিকায়, বিবাহিত নারীগণ তাহার নিকট অবিবাহিতা নারী অপেক্ষা কম সম্মান লাভ করিতেন না। ঐ সমুদ্রযাত্রাকালে জাহাজে কয়জন পাদরী কয়েকগাছা বিবাহকালীন রূপার বালা সকলকে দেখাইতেছিল; ঐগুলি দুর্ভিক্ষের দারুণ সঙ্কটকালে তামিল রমণীগণের নিকট তাহারা ক্রয় করে। কথাপ্রসঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সকল দেশের স্ত্রীলোকেই কুসংস্কারবশতঃ অঙ্গুলি বা মণিবন্ধ হইতে বিবাহ-অঙ্গুরীয় বা বলয় খুলিয়া দিতে আপত্তি করিয়া থাকে, এই কথা উঠিল। শুনিয়াই স্বামীজী সবিস্ময়ে বেদনাপূর্ণ অনুচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “তোমরা একে কুসংস্কার বলছ? এর পেছনে যে উঁচুদরের সতীত্বের আদর্শ রয়েছে, তা তোমরা দেখতে পাচ্ছ না?” (১)
কিন্তু বিবাহ দ্বারা আদর্শ আধ্যাত্মিক স্বাধীনতালাভের যতটা সহায়তা হয় তাহা দেখিয়াই তিনি উক্ত প্রথার গুণাগুণ বিচার করিতেন। এখানে স্বাধীনতা’ শব্দটি প্রাচ্যদেশীয় অর্থে বুঝিতে হইবে, অর্থাৎ স্বাধীনতা বলিতে কোন কিছু করিবার অধিকার বুঝায় না, পরন্তু কোন কিছু করিবার ইচ্ছাকে দমন করিয়া নিশ্চেষ্ট থাকিবার অধিকার বুঝায়—উহার লক্ষ্য হইল নৈষ্কর্ম সকল কর্মের পারের অবস্থা। একদিন তর্কস্থলে তিনি স্বীকার করেন, “বিবাহের পারে যাবার জন্যই বিবাহ করা, এর বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলবার নাই।” তাঁহার গুরুদেবের, তাঁহার গুরুভ্রাতা যোগানন্দের এবং তাহার শিষ্য স্বরূপানন্দের যে প্রকার বিবাহ হয়, তাহার বিবেচনায় উহাই আদর্শ বিবাহ। এইরূপ বিবাহ অন্যদেশে নামমাত্র বিবাহ বলিয়া পরিগণিত হইত। ঐ বিষয় আলোচনাপ্রসঙ্গে তিনি একবার বলেন, “দেখছ, এ বিষয়ে ভারত ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। পাশ্চাত্যের বিবাহ বলতে বোঝায়, আইনবন্ধনের বাইরে যাকিছু, কিন্তু ভারতবর্ষে বিবাহ বলতে বোঝায় যে, সমাজ দুটি প্রাণীকে অনন্তকালের জন্য একটা বন্ধনে আবদ্ধ করে দিল। এই দুটি প্রাণীকে তাদের ইচ্ছা থাকুক, বা না থাকুক, জন্মে জন্মে পরস্পরকে বিবাহ করতেই হবে। এই উভয়ের প্রত্যেকেই অপরের কৃত ভালমন্দের অর্ধেকের ভাগী হয়। আর যদি একজন এ জীবনে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়ে বলে বোধ হয়, তাহলে অপরকে অপেক্ষা করতে হবে, যতদিন না সে আবার তার নাগাল পায়।”
শুনা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ বিবাহকে মাত্র কয়েকজনের সেবা এবং সন্ন্যাসকে জগতের সেবা বলিয়া উল্লেখ করিতেন। এরূপস্থলে মনে হয়, তিনি সর্বোচ্চস্তরের বিবাহের কথাই বলিতেন। স্বামীজীর নিজের মনেও যে ইহাই ব্রহ্মচর্যের মূল ধারণা ছিল, একথা স্পষ্ট বুঝা যায়। যেন সর্বশ্রেষ্ঠ যশলাভের জন্য যুদ্ধার্থে আহ্বান করিতেছেন, এইভাবে তিনি লোকদের ঐ ব্ৰতগ্রহণে আহ্বান করিতেন। সন্ন্যাসিসঘকে তিনি যেন আচার্যের পশ্চাতে অবস্থিত একদল সৈন্য’ বলিয়া জ্ঞান করিতেন, এবং তাহার মতে যে আচার্যের শিষ্যগণ সকলেই নাগরিক ও গৃহস্থ, তাহার কোন সৈন্যই নাই। যাহার এই সহায় বর্তমান এবং যাহার এই সহায়ের অভাব এই উভয়পক্ষের শক্তি সম্বন্ধে কোন তুলনাই করা চলে না, ইহাই ছিল তাহার ধারণা।