সন্ন্যাসীদের শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি সর্বদা বিশেষ জোর দিয়া বলিতেন যে, সন্ন্যাসী নিজেকে পুরুষ বা নারী কিছুই ভাবিবেন না, কারণ তিনি ঐ উভয়ের পারে গিয়াছেন। যাহা কিছু—এমনকি শিষ্টাচারও–লিঙ্গভেদের কথা মনে পড়াইয়া দেয়, তাহাই তাঁহার নিকট ঘৃণার্থ বলিয়া মনে হইত। পাশ্চাত্যে যাহা ‘শিভালরি’ (অর্থাৎ নারীর প্রতি অতি মাত্রায় সৌজন্য প্রকাশ) বলিয়া অভিহিত, তাহার নিকট উহা নারীজাতির প্রতি অপমানসূচক বলিয়া বোধ হইত। মেয়েদের সাধারণ জ্ঞান যথেষ্ট, এবং পুরুষদের জ্ঞানে যেন সহানুভূতির আধিক্য না থাকে—কোন কোন লেখকের এই মত স্বামীজীর নিকট অতি নীচ এবং উপেক্ষার বিষয় বলিয়া গণ্য হইত। মানবের অন্তরাত্মা চায় স্বাধীনতা; আমাদের দৈহিক গঠন তাহার উপরে জোর করিয়া যে-সব বন্ধন আনিয়া দিয়াছে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই উহা অতিক্রম করিতে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
নির্জনবাস, সংযম এবং চিত্তের গভীর একাগ্রতা—এই সকলের সংযোগে গঠিত ছাত্রজীবনের আদর্শই ভারতবর্ষে ‘ব্রহ্মচর্য নামে অভিহিত। স্বামীজী বলিতেন, “ব্রহ্মচর্য শিরায় শিরায় জ্বলন্ত আগুনের মতো প্রবাহিত থাকা চাই।” ছাত্রজীবনের আনুষঙ্গিক পাঠ্যবিষয়ে মনঃসংযোগ তাহার নিকট অনন্তের মধ্যে সান্তকে বিলীন করিয়া দিবার অন্যতম পন্থামাত্র; এবং এই অনন্তের মধ্যে সান্তের বিলোপসাধন তাহার নিকট সকল মহৎ জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলিয়া বোধ হইত, যাহার জন্য যে রোবল্পীয়র গোড়ামি দ্বারা বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাঁহাকে পর্যন্ত তিনি প্রশংসা করিতে প্রলুব্ধ হইয়াছিলেন। তিনি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করিতেন, যে-কোন কার্য—যাহাতে হৃদয়, মন ও শরীরের সর্বোত্তম বিকাশসাধনের প্রয়োজন, তাহার প্রস্তুতির জন্য সরস্বতীপূজা একান্ত আবশ্যক; অবশ্য সরস্বতীপূজা বলিতে তিনি বুঝিতেন ভাবরাজ্যে গভীর তন্ময়তা এবং পূর্ণ সংযম।
কুস্তিগিরদের উপযুক্ত শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ হিসাবে এরূপ পূজা ভারতবর্ষে যুগযুগান্তর হইতে সমাদর লাভ করিয়া আসিয়াছে; ইহার তাৎপর্য এই যে, যদি কেহ মধ্যে মধ্যে সেই অতিচেতনার অন্তর্দৃষ্টির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিতে চান, যাহা অপরের নিকট দিব্যজ্ঞান, ঐশীপ্রেরণা অথবা অনন্যসাধারণ দক্ষতা বলিয়া প্রতীত হয়, তাহা হইলে তাহাকে সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করিতে হইবে। ধর্মের ন্যায় সুকুমার শিল্প ও বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ কীর্তির জন্যও ঐরূপ দিব্যজ্ঞান বিশেষ প্রয়োজন। যে ব্যক্তি ঐরূপ দিব্যজ্ঞানলাভের পরিবর্তে স্বার্থপর অথবা হীন উপায়ে নিজের শক্তিক্ষয় করিতেছে, সে কদাপি রাফেলের ন্যায় অপূর্ব মাতৃমূর্তি অঙ্কনে অথবা মাধ্যাকর্ষণ-নিয়ম আবিষ্কারে সমর্থ হয় না। আধ্যাত্মিক আদর্শের ন্যায় নাগরিক বা রাষ্ট্রীয় আদর্শসিদ্ধির জন্যও একান্ত প্রয়োজন সন্ন্যাসিসুলভ নিষ্ঠাভক্তি। কৌমারব্রত গ্রহণের অর্থই দশের কল্যাণের জন্য ব্যক্তিসুখ বিসর্জন দেওযা। এইরূপে স্বামীজী উপলব্ধি করেন যে, সংযম ব্যতীত প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশ হইতে পারে না; হৃদয়ঙ্গম করেন, যে পথ দিয়া হউক, প্রকৃত মহত্ত্ব অর্জনের জন্য প্রয়োজন দেহের প্রবৃত্তির উপর আত্মার জয়লাভ এবং পরিশেষে ইহাও তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, একজন শ্রেষ্ঠ সাধুর মধ্যে মহৎ কর্মী অথবা রাজ্যের শ্রেষ্ঠ নাগরিক হইবার সামর্থ্যও প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত থাকে। ইহার বিপরীত পক্ষ—অর্থাৎ যেখানে ব্রহ্মচারিণী বা সন্ন্যাসিনীগণের উদ্ভব হওয়া সম্ভব সেখানেই কেবল যথার্থ উন্নতচরিত্রা পত্নী অথবা শ্রেষ্ঠ নাগরিক জন্মিতে পারে, এ বিষয়ে তাঁহার ঐরূপ স্পষ্ট ধারণা ছিল কিনা বলিতে পারি না। আমার মনে হয়, সম্ভবতঃ তিনি নিজে সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসপ্রার্থীদের গুরু ছিলেন বলিয়া, কিঞ্চিৎ আভাস ব্যতীত এই মহাসত্যটি তাহার নিকট প্রচ্ছন্ন রহিয়া গিয়াছিল; অবশেষে মহাপ্রয়াণের পূর্বে তিনি ঐ বিষয়ে চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন। একবার তিনি বলেন, “একথা সত্য যে, এমন সব নারী আছেন, যাদের উপস্থিতিই মানুষকে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়; আবার এমন নারীও আছে, যারা তাকে নরকের দিকে ঠেলে দেয়।”
তাঁহার নিকট অবস্থানকালে, যে-ভালবাসা প্রেমাস্পদের দ্বারা কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিয়া লইতে চায়, তাহাকে সর্বতোভাবে আপনার বশীভূত করিয়া রাখিতে চায়, অথবা নিজের সুখ বা কল্যাণসাধনের উপায় করিয়া তোলে, সে-ভালবাসাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখা কাহারও পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাহার পরিবর্তে প্রেমপদবাচ্য হইবার জন্য প্রেমকে চিরন্তন কল্যাণের প্রস্রবণস্বরূপ হইতে হইবে। প্রেম নিজেকে বিনামূল্যে বিলাইয়া দেয়; প্রেম অহেতুক, এবং প্রতিদানের আকাঙক্ষারহিত। তিনি যে সর্বদা ‘অনাসক্তভাবে ভালবাসার কথা বলিতেন ইহাই তাহার অর্থ। বস্তুতঃ একবার কোন ভ্রমণান্তে প্রত্যাবর্তন করিয়া তিনি আমাদের বলেন, এইবার তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন যে, কোন বিষয় হইতে মন উঠাইয়া লইবার শক্তির ন্যায় কোন বিষয়ে মন লাগাইবার শক্তিও অনুরূপভাবে প্রয়োজনীয়। উভয়ই তৎক্ষণাৎ পূর্ণমাত্রায় এবং সর্বান্তঃকরণে নিষ্পন্ন হওয়া চাই; এবং এই উভয়ের একটি আর একটির পরিপূরক। ইংলণ্ডে তিনি বলেন, “প্রেম সব সময়ে আনন্দেরই বিকাশমাত্র; তার উপর লেশমাত্র দুঃখের ছায়া পড়ার অর্থ দেহসুখ কামনা ও স্বার্থপরতা।”