তাহার নিজ জীবনের এই উপাদান বা গুণ—যাহা তাহার মহত্ত্ব ও বীরোচিত সবকিছুর স্বীকৃতিজ্ঞাপক, ইতিপূর্বে প্রকাশিত আদর্শবিশেষের পরিচায়ক অথবা উদাহরণরূপে পরিগণিত—সে সম্পর্কে স্বামীজী স্বয়ং অবশ্য অবহিত ছিলেন না। তথাপি মনে হয়, ইহার মধ্যেই তাঁহার সকল জিনিস ধরিবার ও বুঝিবার যে ক্ষমতা তাহার শ্রেষ্ঠ বিকাশ নিহিত। শিক্ষাসংক্রান্ত তাহার বিশদ ইঙ্গিতগুলি সম্পর্কে বক্তব্য এই যে, শিক্ষাব্যাপারে উহাদের যৌক্তিকতা আমার নিকট সর্বদাই বিস্ময়কর। যদিও তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে, এক সময়ে তাহাকে দুঃখ-দারিদ্র্যেরসহিত কঠোর সংগ্রাম করিতে হয় এবং সেই সময় তিনি হার্বার্ট স্পেন্সারের শিক্ষা (Education) নামক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করিবার ভার লন; এবং ক্রমশঃ ঐ বিষয়ে আকৃষ্ট হইয়া পেস্তালৎসি(২) রচিত যে পুস্তকগুলি পাইয়াছিলেন, তাহাও অধ্যয়ন করেন, যদিও উহা তাহার পাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তথাপি এই ঘটনাটি শিক্ষাবিষয়ে তাহার গভীর জ্ঞানের যথেষ্ট কারণ বলিয়া আমার কখনও মনে হয় নাই।
প্রকৃতপক্ষে হিন্দুগণ মনের ক্রিয়াকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিতে এত নিপুণ, এবং ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে মানসিক বৃত্তিসমূহের বিকাশসাধনের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত সর্বদা তাহাদের সামনে অবস্থান করে যে, শিক্ষাসংক্রান্ত মতামতের আলোচনা-জগতে তাঁহারা অন্য জাতি অপেক্ষা প্রচুর সুবিধা লাভ করিয়া থাকেন। একথা ভাবিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ঐ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিন্তা করার রহস্য তাঁহারা একদিন আয়ত্ত করিয়া ফেলিবেন। ইতিমধ্যে ঐ আদর্শের পরিপূর্ণতালাভের প্রথম সোপান হইল প্রচলিত প্রথাগুলির মধ্যে কি বিপুল উন্নতির সম্ভাবনা রহিয়াছে তাহা ধারণা করা। স্বামী বিবেকানন্দের কল্পনার বিস্তার ও পূর্ণতা সম্পাদনের ভার ভাবতীয় শিক্ষাবিগণের উপর নিহিত। যখন উহা সম্পূর্ণ হইবে, যখন তাহার অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতির সহিত ভাবী বংশধরগণ সম্বন্ধে তাহার সাহস ও আশা এবং জ্ঞানমাত্রেই পবিত্রবোধে তাহার আনুগত্য-এই সকল একত্র যুক্ত করিতে আমরা সমর্থ হইব, তখনই বুঝিতে হইবে, জগতের নারীজাতির মধ্যে ভারতীয় নারীর যথার্থ স্থান অধিকারের দিন সমাগতপ্রায়।
———
* ব্ৰহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ ও নৃযজ্ঞ।
“অধ্যাপনং ব্রহ্মযজ্ঞঃ পিতৃযজ্ঞশ্চ তর্পণম।
হোমো দৈবো, বলিভৌতো, নৃযজ্ঞোহতিথিপূজনম।”—মনু, ৩।৭০–অনুঃ
১ মহকালী পাঠশালার প্রতিষ্ঠাত্রী
২ পেস্তালৎসি (Pestalozzi) জীবনের কতক অংশ শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্যা লইয়া অতিবাহিত করেন। ঐ সম্বন্ধে তিনি কয়েকখানি পুস্তকও রচনা করেন। তিনি ১৭৪৬ খ্রীস্টাব্দে সুইজারল্যাণ্ডের জুরিক (Zurich) শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮২৭ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।–অনুঃ
২২. সন্ন্যাস ও গার্হস্থ্য
স্বামীজীর দৃষ্টিতে তাহার সন্ন্যাসের ব্ৰতগুলি ছিল অতিশয় মূল্যবান। যে-কোন অকপট সন্ন্যাসীর ন্যায় তাহার নিজের পক্ষে বিবাহ অথবা তৎসংশ্লিষ্ট কোন ব্যাপার মহাপাপ বলিয়া গণ্য হইত। ঐ-বিষয়ক প্রবৃত্তির স্মৃতি পর্যন্ত মনে স্থান পাইবে না, ইহাই ছিল তাঁহার আদর্শ এবং কায়মনোবাক্যে নিজেকে এবং নিজের শিষ্যগণকে উহার লেশমাত্র সম্ভাবনা হইতেও তিনি দূরে রাখিবার চেষ্টা করিতেন। অবিবাহিত থাকাটাই তাহার নিকট এক আধ্যাত্মিক সম্পদ বলিয়া পরিগণিত হইত। এইসকল পর্যালোচনা করিলে বুঝা যায়, তিনি যে শুধু সন্ন্যাস-জীবনে চরম উৎকর্ষলাভের জন্যই সর্বদা উৎসুক থাকিতেন তা নয়, ব্রতভঙ্গের আশঙ্কাতেও সর্বদা ভীত থাকিতেন। এই ভয় তাহার নিজের আদর্শ-উপলব্ধির পক্ষে যতই সহায়ক ও আবশ্যক বলিয়া বোধ হউক, নিঃসন্দেহে উহা বহু বৎসর ধরিয়া এই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে একটা চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে দেয় নাই।
কিন্তু একথা যেন সকলে উপলব্ধি করেন যে, তিনি স্ত্রীলোক হইতে ভয় পাইতেন না, তাহার ভয় ছিল প্রলোভনকে। পৃথিবীর সর্বত্র তাহাকে মেয়েদের সহিত যথেষ্ট মিশিতে হইয়াছিল। তাহারা ছিলেন তাহার শিষ্য, কার্যের সহায়ক, এমনকি, বন্ধু এবং খেলার সাথীও। তাহার পরিব্রাজক-জীবনের এই সকল বন্ধুর সহিত ব্যবহারে তিনি প্রায় সর্বদাই ভারতের পত্নীগ্রামের প্রথা অবলম্বন করিতেন, এবং তাহাদের সহিত কোন একটা পারিবারিক সম্পর্ক পাতাইয়া লইতেন। কোন স্থানের মেয়েরা তাহার ভগিনী হইল, কোথাও বা মাতা, কোথাও কন্যা, এইরূপ সর্বত্র। ইহাদের মহত্ত্ব এবং মিথ্যা বা তুচ্ছ ভাবরাহিত্য সম্বন্ধে তিনি কখন কখনও গর্ব প্রকাশ করিতেন; কারণ, তাঁহার নিজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মার্জিত ব্যক্তিগণের যে বৈশিষ্ট্য তাহা অত্যন্ত অধিক পরিমাণে ছিল, সেজন্য নারীগণের মধ্যে তিনি ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতার পরিবর্তে মহত্ত্ব ও চারিত্রিক শক্তিরই অন্বেষণ করিতেন। আমেরিকায় তিনি মেয়েদের নৌকা চালানো, সন্তরণ ও নানাপ্রকার ক্রীড়া দেখিয়া বিশেষ আনন্দলাভ করেন। তাহার নিজের ভাষায় “এইসব মেয়েদের একবারও মনে হয় না যে, তারা ছেলে নয়।” ঐরূপে তাহারা যে পবিত্রতার আদর্শের মূর্ত বিগ্রহ বলিয়া তাহার বোধ হইয়াছিল, সেই আদর্শ তিনি পূজা করিতেন।