গৃহ পরিবেশ কিরূপ হইলে স্ত্রীশিক্ষাকার্যটি সর্বতোভাবে প্রগতিশীল ও সম্পূর্ণ হিন্দুভাবে পরিচালিত হইতে পারে, এই সমস্যা তাহার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছিল। অধিকন্তু, পুরাতন পদ্ধতির নিয়মগুলির এরূপ আকার দান করিতে হইবে, যাহাতে তাহারা বরাবর আধুনিকভাবাপন্ন ব্যক্তিগণের শ্রদ্ধা আকর্ষণে সক্ষম হয়। সামাজিক স্থায়িত্ব ও সুসঙ্গতির উপর বিদেশী ভাবাদর্শের ফলাফল বিচার না করিয়া অতি সহজেই তাহাদের গ্রহণ করিয়া লওয়ার ফলে চরিত্রের দিক দিয়া এবং নীতিগত যে ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ হয়, তাহা সর্বদাই তাহার দৃষ্টিপথে পড়িত। স্বাভাবিক সংস্কারবশে তিনি জানিতেন, প্রাচীন সমাজ যেসকল বন্ধন দ্বারা ঐক্যবদ্ধ ছিল, আধুনিক শিক্ষার আলোকে তাহাদের নূতন করিয়া অনুমোদন লাভ এবং পবিত্ৰতররূপে পরিগ্রহণ একান্ত আবশ্যক, নতুবা ঐ শিক্ষা শুধু ভারতের অধঃপতনের সূচনামাত্র বলিয়া প্রমাণিত হইবে। কিন্তু তিনি কদাপি চিন্তা করেন নাই যে, এই প্রাচীন ও নূতনের সমন্বয়সাধন সহজসাধ্য। কিরূপে আধুনিক ভাবকে জাতীয়তাসম্পন্ন এবং প্রাচীন ভাবকে আধুনিক যুগের উপযোগী করিয়া তোলা যায়—যাহাতে উভয়ের মধ্যে ঐক্য সাধিত হইতে পারে এই কঠিন সমস্যা তাহার অধিকাংশ সময় ও চিন্তা অধিকার করিয়া থাকিত। তিনি ঠিকই বুঝিয়াছিলেন যে, যখন এই উভয়কে সংযোগ করিয়া একত্র করা যাইবে, তখনই জাতীয় শিক্ষার সূচনা ঘটিবে, তাহার পূর্বে নহে।
কি উপায়ে হিন্দুজীবনের প্রচলিত ঋণগুলিকে নূতনভাবে ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে, যাহাতে দেশ ও ইতিহাসের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে আধুনিক চেতনা উহার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লওয়া যায়, তাহা সহসা একদিন তাহার মনে উদিত হয়, এবং তিনি বলিয়া ওঠেন, “এই পঞ্চযজ্ঞের ব্যাপার নিয়েই কত কী করা যায়! কত বড় বড় কাজেই এগুলিকে লাগানো যেতে পারে!”
বিষয়টি সম্পর্কে তাহার মনে সহসা এক নূতন আলোকপাত হইয়াছিল, কিন্তু মন হইতে চলিয়া যায় নাই। ঐ ভাবটির সূত্র ধরিয়া তিনি ক্রমশঃ উহার বিস্তৃত অবতারণা করিলেন।
“[পিতৃযজ্ঞ] প্রাচীনযুগের ঐ পিতৃউপাসনা থেকে তোমবাবীরপূজার সৃষ্টি করতে পার।
“[দেবযজ্ঞ] দেবপূজায় অবশ্য প্রতিমাদির ব্যবহার চাই। কিন্তু তোমরা তাদের পরিবর্তন সাধন করতে পার। মা কালীকে সব সময় এক অবস্থায় দণ্ডায়মান রাখবার প্রয়োজন নেই। তোমার ছাত্রীদের নূতন নূতন ভাবে মা কালীকে কল্পনা করতে উৎসাহ দাও। দেবী সরস্বতীকে একশতভাবে ধারণা কর। মেয়েরা নিজ নিজ ভাব অনুযায়ী মূর্তি গঠন করুক এবং চিত্র অঙ্কন করুক।
“পূজার ঘরে বেদীর সবচেয়ে নিম্নধাপে সব সময় একটি জলপূর্ণ কলস থাকবে, এবং তামিলদেশের মতো সর্বদাই বড় বড় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলবে। আর যদি ঐসঙ্গে দিবারাত্র ভজন-পূজনের ব্যবস্থা করতে পারা যায়, তাহলে তার চেয়ে হিন্দুভাবের পোষক আর কিছুই হতে পারে না।
“কিন্তু পূজার অনুষ্ঠানগুলির ব্যবস্থা যেন অবশ্যই বৈদিক হয়। বৈদিক যুগের মতো একটি বেদী থাকবে, এবং পূজাকালে তাতে বৈদিক অগ্নি প্রজ্বলিত হবে। ছোট ছোট মেয়েরাও তাতে অবশ্যই যোগ দিয়ে আহুতি দেবে। এই অনুষ্ঠান সমগ্র ভারতে শ্রদ্ধা অধিকার করবে।
“[ভূতযজ্ঞ] নানারকম জন্তু রাখবে। গরু থেকে আরম্ভ করলে ভালই হবে। কিন্তু কুকুর, বিড়াল, পাখি প্রভৃতি অন্যান্য জীবজন্তুও রাখবে। ছোট ছোট মেয়েদের তাদের খাওয়াবার ও যত্ন করবার একটা সময় নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
“[ব্ৰহ্মযজ্ঞ] তারপর বিদ্যাযজ্ঞ। এটি সবচেয়ে সুন্দর। ভারতে প্রত্যেক বই-ই পবিত্র; একথা জান কি? শুধু বেদ নয়, ইংরেজী, মুসলমানী সব বই। সব পবিত্র।
“পুরানো কলাবিদ্যাগুলি আবার উদ্ধার কর। তোমার মেয়েদের খোয়াক্ষীর দিয়ে নানারকম ফলের আকার তৈরি করতে শেখাও। তাদের সুন্দর, শিল্পসম্মত রন্ধন ও সেলাই শেখাও। তারা ছবি আঁকা, ফটো তোলা, কাগজের নানারকম নক্সা কাটা এবং সোনারূপার তার দিয়ে লতাপাতা তৈরি করা ও ছুঁচের কাজ শিখুক। লক্ষ্য রাখবে, প্রত্যেকে যেন এমন কিছু বিদ্যা শেখে, যার দ্বারা প্রয়োজন হলে জীবিকা অর্জন করতে পারে।
“[নৃযজ্ঞ] মানুষের সেবার কথা কদাপি ভুলে যেও না। সেবার ভাব থেকে মানুষকে পূজা করার ভাব ভারতে বীজাকারে বর্তমান আছে, কিন্তু তার প্রতি কখনও বিশেষ জোর দেওয়া হয়নি। তোমার মেয়েরা এর বিকাশসাধন করুক। একে কাব্য ও চারুকলার অঙ্গ করে নিও। হ, প্রত্যহ স্নানের পর এবং আহারের পূর্বে ভিক্ষুকদের পা পূজা করলে একসঙ্গে হৃদয় ও হাতের আশ্চর্যরকম যথা শিক্ষা হবে। কোন কোন দিন আবার ছোট ছোট মেয়েদের—তোমার নিজের ছাত্রীদেরই পূজা করতে পার। অথবা তুমি অপরের শিশু সন্তানদের চেয়ে এনে তাদের সেবাশুশ্রুষা করতে ও আহার করাতে পার। মাতাজী(১) আমাকে বলেছিলেন, স্বামীজী! আমার কোন সহায় নেই। কিন্তু আমি এই পবিত্র কুমারীদের পূজা করে থাকি, এরাই আমাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে।’ দেখলে, তিনি প্রাণে প্রাণে অনুভব করেন যে, এইসব কুমারীদের মধ্যে তিনি উমারই সেবা করছেন। বিদ্যালয় আরম্ভ করবার পক্ষে এ ভাবটি অতি চমৎকার।”
কিন্তু এইরূপে প্রাচীন ও নূতনের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য তিনি বিশদ চিত্র অঙ্কনে প্রবৃত্ত হইলেও ইহা সর্বদাই সত্য ছিল যে, তাহার উপস্থিতিই ছিল আদর্শটিকে গ্রহণ করিবার উপায়স্বরূপ—প্রত্যেক আন্তরিক প্রচেষ্টাকেই উহা আদর্শের সহিত প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করিয়া দিত। অতি স্থূলদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকটেও প্রাচীন অনুষ্ঠানাদির যথার্থ মর্ম উদঘাটন করিয়া দিত। তাহার প্রভাবেই আধুনিকভাবাপন্ন হিন্দুগণ কর্তৃক স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে ঐ সকল অনুষ্ঠান পুনরায় আচরিত হইয়া সহসা উহাদের প্রাণপ্রদ ও মূল্যবান করিয়া তুলিত। এইরূপে, ইউরোপীয় বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে যে সকল বীরহৃদয় মনীষী জীবন আহুতি দিয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি জনৈক ভারতীয় মহান্ বৈজ্ঞানিকের শ্রদ্ধা দেখিয়া মনে হইল, উহা প্রাচীনযুগের আচাৰ্যকুলবরই আধুনিক রূপান্তরমাত্র। ব্রহ্মজ্ঞানই যে-জাতির জীবনের চরম লক্ষ্য, তাহার পক্ষে জ্ঞানের বাহ্যপ্রয়োগ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকিয়া কেবল জ্ঞানের জন্যই জ্ঞানচর্চা অবশ্যম্ভাবী মহত্ত্ব বলিয়াই বোধ হয়। নাম, যশ ও ঐশ্বর্যের প্রতি প্রশান্ত নিরাসক্তি ইহাই প্রমাণ করে যে, কর্মী নাগরিক ও গার্হস্থ্য জীবনযাপন করিলেও ধর্মের দিক হইতে তিনি সন্ন্যাসীই।