তথাপি কোন পাশ্চাত্য শিষ্যের নিকট আদর্শরূপে তিনি যে নিয়মানুবর্তিতা উপস্থিত করিতেন, তাহা কর্তৃপক্ষের বা বিদ্যালয়ের কঠোর আনুগত্য নহে; উহা যেন কোন হিন্দু বিধবার পরিবারের মধ্যে অবস্থান করিয়া স্বাধীনভাবে নিজ নিয়মগুলি পালন করিয়া যাওয়া। চরিত্রবতী নারীর আদর্শ বলিতে তিনি বুঝিতেন ‘নিষ্ঠাবতী হিন্দু ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারিণী।’ যে আনন্দের সহিত তিনি ঐ কয়েকটি কথা উচ্চারণ করিতেন তাহা বর্ণনা করা যায় না!
এই বিষয়টির আলোচনা-প্রসঙ্গে একদিন তিনি বলেন, “তোমার ছাত্রীদের জন্য কতকগুলো নিয়ম কর, এবং ঐ নিয়ম সম্বন্ধে তোমার মতামতও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দাও। সুবিধা হলে একটু উদার ভাবের প্রশ্রয় দিও। কিন্তু মনে রেখো যে, সমগ্র জগতে পঁচ-ছ জনের বেশি লোক কখনো একসঙ্গে ঐ ভাব গ্রহণ করবার উপযুক্ত নয়! সম্প্রদায়ের ব্যবস্থা থাকবে, আবার সেই সঙ্গে সম্প্রদায়ের গণ্ডির বাইরে চলে যাবার ব্যবস্থাও থাকবে। তোমার সহকারিণীদের তোমাকেই প্রস্তুত করে নিতে হবে। নিয়ম কর, কিন্তু এমনভাবে কর যে, যারা নিয়ম ব্যতীত কাজ করবার উপযুক্ত হয়েছে, তারা যেন সহজে ওগুলি ভেঙে ফেলতে পারে। আমাদের মৌলিকত্ব হলো, পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে পূর্ণ শৃঙ্খলা। সন্ন্যাসী-সঙেঘও তা করা যেতে পারে। আমার নিজের কথা বলতে গেলে, আমি সব সময় অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই এবং তার ফলে বুঝতে পারি, ওটা সম্ভবপর।”
সহসা তিনি এই প্রসঙ্গ ত্যাগ করিলেন এবং যে প্রসঙ্গ সর্বদা তাহার নিকট প্রীতিকর ছিল ও যথাযথ প্রয়োগের দ্বারা যাহা ফলপ্রদ হইবে বলিয়া তিনি বিশ্বাস করিতেন, তাহার অবতারণা করিলেন। বলিলেন, “দুটো বিভিন্ন জাতের মেলামেশার ফলে তাদের মধ্য থেকে এক নতুন ধরনের শক্তিশালী জাতের উদ্ভব হয়। এই নতুন জাতটা নিজেকে অপরের সঙ্গে মিশে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করে, আর এখানেই জাতিভেদের আরম্ভ। দেখ না, যেমন আপেল। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালজাতের আপেলগুলি বিভিন্ন জাতের সংযোগে উৎপন্ন হয়েছে, কিন্তু একবার ঐভাবে উৎপন্ন হবার পর আমরা ঐ বিশেষ জাতের আপেল বার বার পৃথক রাখবার চেষ্টা করে থাকি।”
কয়েকদিন পরে আবার ঐ চিন্তাই স্বামীজীর মনে প্রবল হইয়া উঠিল, এবং তিনি বিশেষ আগ্রহের সহিত বলিলেন, “আমি ভবিষ্যতের যতটা দেখতে পাচ্ছি, তাতে একটি বলশালী ও পৃথক নতুন জাত সর্বদাই শরীর-ভিত্তিক। সর্বজনীনতা, উদারভাব প্রভৃতি মুখে বলা খুব সহজ, কিন্তু এখনো লক্ষ লক্ষ বছর জগৎ এব জন্য তৈরি হতে পারবে না।”
তিনি আবার বলিলেন, “মনে রেখো, যদি তুমি জানতে চাও, একখানা জাহাজ দেখতে কি রকম,তাহলে জাহাজটি ঠিক যেমন, তেমন তার বর্ণনা দিতে হবে তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আকার, এবং কোন্ কোন্ উপাদানে তৈরি; কোন জাতকে বুঝতে হলেও আমাদের অনুরূপভাবে বুঝতে হবে। ভারত মূর্তিপূজক দেশ, স্বীকার করি। সে যেমন, তাকে ঠিক তেমনভাবে সাহায্য করতে হবে কিছু বাদ দিলে চলবে না। যারা তাকে ত্যাগ করেছে, তারা তার কোন উপকারই করতে পারবে না।”
স্বামীজী প্রাণে প্রাণে বুঝিতেন, ভারতে স্ত্রীশিক্ষাবিস্তারের ন্যায় আর কিছুই তত প্রয়োজন নহে। তাহার নিজের জীবনে দুটি সঙ্কল্প ছিল—একটি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের জন্য মঠ স্থাপন, এবং অপরটি নারীজাতির শিক্ষাকল্পে কোন উদ্যমের সূত্রপাত করিয়া যাওয়া। তিনি প্রায়ই বলিতেন, “পাচশত পুরুষের সাহায্যে ভারতবর্ষ জয় করতে পঞ্চাশ বছর লাগতে পারে, কিন্তু পাচশত নারীর দ্বারা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা সম্ভব।”
শিক্ষা দিয়া তৈয়ারি করিয়া লইবার জন্য বিধবা ও অনাথাদের সংগ্রহ করা সম্বন্ধে তাঁহার মত ছিল, জন্মগত উচ্চ-নীচ ভেদ দৃঢ়তার সহিত উপেক্ষা করিতে হইবে। কিন্তু এ বিষয়ে কৃতকার্য হইতে গেলে, যাহাদের নির্বাচন করা হইবে, তাহারা’ যাহাতে অল্পবয়স্ক ও পূর্বেই কোন নির্দিষ্টরূপে গঠিত না হইয়া থাকে, তাহা দেখা একান্ত আবশ্যক। প্রায়ই তিনি বলিতেন, “জন্ম কিছুই নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থাই সব।” কিন্তু সর্বোপরি তিনি উপলব্ধি করিতেন যে, এ বিষয়ে কোনরূপ অসহিষ্ণুতা অমার্জনীয়। যদি বার বৎসরে কোন ভাল ফল দৃষ্ট হয়, তবে বুঝিতে হইবে, বিশেষ সাফল্য হইয়াছে। কাজটি এতই গুরুতর যে, উহার সম্পাদনে সত্তর বৎসর লাগিলেও তাহা অধিক নহে।
ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া তিনি বসিয়া থাকিতেন এবং স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করিতেন, একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন সম্বন্ধে আকাশকুসুম রচনা করিতেন, এবং ঐ-সংক্রান্ত নানা বিষয়ে সাদরে বর্ণনা করিতেন। হয়তো উহার কোন অংশই যথাযথভাবে কার্যে পরিণত হইবে না, তথাপি উহার সবটাই নিশ্চয় মূল্যবান। কারণ, উহা দ্বারা বুঝা যায়, তিনি কতটা স্বাধীনতা দিবার পক্ষপাতী ছিলেন এবং তাহার দৃষ্টিভঙ্গিতে কিরূপ ফললাভ বাঞ্ছনীয় বলিয়া বোধ হইত।
ইহা খুব স্বাভাবিক ছিল যে, পরিকল্পিত কার্যপ্রণালী একটা ধর্মভাবে অনুরঞ্জিত হইবে। কারণ, আমার নিজের দিক দিয়া আমি সেই সময় হিন্দুধর্মের চিন্তা ও আদর্শের আলোচনায় বিশেষ ব্যাপৃত ছিলাম। ঐ কার্যপ্রণালী আবার পাণ্ডিত্যের দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া সাধুজীবনযাপনের অনুকূল করিবার দিকে বিশেষ চেষ্টা ছিল। কোন্ কোন্ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হইবে, তাহার অপেক্ষা শিক্ষার প্রকৃতি ছিল তাহার সমধিক চিন্তার বিষয়। আমাদের বিদ্যালয় থেকে এমন সব মেয়ে শিক্ষিতা হবে, যারা ভারতের সকল মেয়ে পুরুষের মধ্যে মনীষায় শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করবে”—একবার মাত্র হঠাৎ এই কথা বলা ব্যতীত আমার মনে পড়ে না যে, স্ত্রীশিক্ষা-পরিকল্পনার ঐহিক দিকটির বিষয়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কখনও কিছু বলিয়াছেন। তিনি ধরিয়া লইয়াছিলেন যে, কোন শিক্ষা বাস্তবিক শিক্ষা নামে অভিহিত হইবার উপযুক্ত কিনা, তাহা উহার গভীরতা ও কঠোরতা দ্বারাই নিরূপিত হইবে। যে মিথ্যা আদর্শ-কল্পনা নারীজাতির জন্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন সাধন অথবা নিম্নতর সত্যলাভই যথেষ্ট বলিয়া বিবেচনা করে, তাহার প্রতি তাহার কোনরূপ বিশ্বাস ছিল না।