আমি আরও দেখিলাম, যে উক্তি শুধু শ্রোতার শ্রবণগোচর না করাইয়া যত্নপূর্বক তাহার মনের মধ্যে গাথিয়া দেওয়া হয়, তাহাতে অধিকতর সাড়া পাওয়া যায়। আর এই সকল মনস্তত্ত্ববিষয়ক আবিষ্কার করিতে আরম্ভ করিয়া ক্রমশঃ বুঝিতে পারিলাম, যদিও একথা বহুপূর্বেই সিদ্ধান্ত হইয়া গিয়াছে যে, বিচারের দ্বারা চৈতন্য ও জড়ের মধ্যে রেখা টানিয়া সম্পূর্ণরূপে পৃথক করিয়া ফেলা অসম্ভব, তথাপি ইহাই যুক্তিযুক্ত বোধ হয়, এই দুইটির মধ্যে অদ্বিতীয় সত্তার যে-দিকটা আমরা জড় বলি, তাহা চৈতন্য বলিয়া যাহাকে অভিহিত করি তাহারই পরিণামস্বরূপ, কিন্তু কোনক্রমেই উহার বিপরীত নহে। ইচ্ছাশক্তি নয়, পরন্তু শরীরকেই জীবত্বের একটি গৌণ ফল মাত্র বলিয়া বিবেচনা করিতে হইবে। ইহা হইতে দেহাতিরিক্ত উচ্চতর এক চৈতন্যের ধারণা আসিল—যাহা জড়ের অধীন না হইয়া বরং জড়কে পরিচালিত করে; সুতরাং শরীর যেমন জীর্ণ ত্বক পরিত্যাগ করে, সেইরূপ উহা জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্তুও গ্রহণ করিতে পারে, অর্থাৎ এই পরিচিত শরীরকেই পরিত্যাগ করিতে পারে। অবশেষে আমি দেখিতে পাইলাম, আমার নিজের মনই “শরীর আসে ও যায়”—স্বামীজীর অমরত্বজ্ঞাপক এই মহান উক্তির প্রতিধ্বনি করিতেছে। কিন্তু চিন্তার এই পরিণতি ধীরে ধীরে সংসাধিত হইয়াছিল, এবং পূর্ণতালাভ করিতে অনেক মাস লাগিয়াছিল।
ইতোমধ্যে যখন আমি পশ্চাতে ফিরিয়া এই সময়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখন অনুভব করি যে, স্বামীজীর ক্লাসগুলিতে আমরা যে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলাম তাহা প্রকৃতপক্ষে তর্কযুক্তিমূলক ব্যাখ্যা নয় বরং বলা যায়, নূতন ও উচ্চভাবময় এক জীবন লাভ, অথবা ভারতে যাহাকে দর্শন বা প্রত্যক্ষানুভূতি বলিয়া অভিহিত করা হয়, তাহাই।
ভগবানকে গোপালভাবে উপাসনা করার বর্ণনাপ্রসঙ্গে আমরা স্বামীজীর বিস্ময়কর উক্তি শ্রবণ করিলাম, “তাহার নিকট আমরা কিছু চাই না কি?” “প্রেম চিরকালই আনন্দের বিকাশমাত্র”, সুতরাং কোনপ্রকার যন্ত্রণা বা অনুশোচনা, স্বার্থপরতা ও দেহসুখসর্বস্বতারই নিদর্শন মাত্র—এই উপদেশ আমরা মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিলাম। আমাদের ও অপরের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভেদদৃষ্টি ‘ঘৃণা’ পদবাচ্য এবং উহার বিপরীতই প্রেম—এই কঠোর নির্দেশ আমরা স্বীকার করিয়া লইলাম। শৈশবের ধর্মমতে যাহারা বিশ্বাস হারাইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে এইরূপ অনুভব করিতেন যে, অন্ততঃ পরোপকার একটি শ্রেষ্ঠ আদর্শ এবং জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য জীবসেবার সম্ভাবনাটা থাকিয়াই যায়। পূর্বোক্তমতে বিশ্বাসী হওয়ায়, “ধর্মদানই শ্রেষ্ঠ, বিদ্যাদান একধাপ নিম্নস্তরের, আর যে কোন প্রকারের দৈহিক বা জাগতিক দান সর্বাপেক্ষা নিম্নস্থানীয়”—এই প্রাচ্যদেশীয় উপদেশটি শুনিয়া আমরা যে বিস্মিত হইয়াছিলাম, আজ দশ বৎসর পরে তাহা স্মরণ করিয়া আমার নিকট কৌতুককর বোধ হইতেছে। ব্যাধি ও দারিদ্র্যপীড়িতের প্রতি আমাদের যে উদ্বেলিত দয়া—এইভাবে তাহার স্থান নির্দেশ করা! এই তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিতে আমার বহু বৎসর লাগিয়াছে, কিন্তু এখন আমি জানি যে, উচ্চতর দানের পশ্চাতে নিম্নতর দানটি আপনা হইতেই আসিয়া থাকে। অনুরূপভাবে, বিশুদ্ধ বায়ু আবশ্যক, এবং আশেপাশের বসতিসমূহ যেন স্বাস্থ্যের অনুকূল হয়, এই নীতির প্রতি পাশ্চাত্য দেশে যে অত্যধিক আগ্রহ প্রকাশ—যেন ঐগুলিই সাধুত্বের লক্ষণ—তাহার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর শিক্ষা পাইলাম-‘জগতের প্রতি উদাসীন হও।’ বস্তুতঃ আমাদের মনে হইল, এই শিক্ষার রহস্য ভেদ করা সাধ্যাতীত। আপাততঃ অসংলগ্ন বোধ হইবে জানিয়াও স্বামীজী যখন সদর্পে বলিলেন, ঋষিরা দৃশ্য উপভোগ করিবার জন্যই পর্বতশিখরে বাস করিতেন, এবং যখন তিনি শ্রোতৃবর্গকে পূজার ঘরে পুস্পাদি রাখিতে ও ধূপধুনা দিতে বলিলেন, আহার ও শরীর বিষয়ে শুদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে বিশেষ যত্ন লইতে উপদেশ দিলেন, তখন এই ধর্মসম্বন্ধীয় দুই বিপরীত ভাবকে কিরূপে সংযুক্ত করিব, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের দেশে প্রচলিত দৈহিক পারিপাট্য নীতিটি ভারতীয় আকারে প্রচার করিতেছিলেন। আর ইহা কি সত্য নহে যে, যতদিন পাশ্চাত্যে আমরা বড় বড় শহরে অবস্থিত বস্তিসমূহ (slums) পরিষ্কার করিতে সমর্থ না হই, ততদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য আমাদের অত্যধিক আগ্রহ বিশেষ সুবিধাভোগী একশ্রেণীর আত্মপূজারই অনুরূপ!
.
যে-সব মহাপুরুষ বিশেষ কুশলতা ও হিসাবী বুদ্ধির সহিত সাংসারিক সকল কাজের সুব্যবস্থা করিতে পারেন, তাহাদের প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা ছিল তাহারও এইরূপ দুর্গতি ঘটিল। প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি জাগতিক বিষয়ের প্রতি কেবল যে উদাসীন, তাহা নহে, ঐগুলির প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন এবং কোনক্রমেই উহা সহ্য করিতে পারেন না। এই উপদেশ স্বামীজী কদাপি খর্ব করিতেন না। এই উপদেশ ঘোষণা করিবার সময় তিনি কখনও ইতস্ততঃ করিতেন না। উচ্চতম আধ্যাত্মিকতায় সাংসারিকতার স্থান নাই।
আমরা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, এগুলি সাধুত্বেরই আদর্শস্বরূপ। আমরা অধ্যায়ের পর অধ্যায় এক মহতী ভাষা শিক্ষা করিতেছিলাম, যাহা দ্বারা জগতের উদ্দেশ্যগুলির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়া আমাদের পক্ষে সহজ হইবে। যে বিষয়গুলি নাগরিক জীবন ও গৃহস্থালী ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট, এবং যাহাদের আত্মোন্নতির হাতেখড়ি (কিণ্ডারগার্টেন) স্বরূপ বলা যাইতে পারে, তাহাদের সম্পর্কে আমাদের কোনরূপ মতিভ্রম উপস্থিত হয় নাই। অপরদেশের গৌরবস্থল শৃঙ্খলা ও দায়িত্বজ্ঞানের আদর্শ সমাদর করিতে শিখিয়াই যে একটি দেশ সর্বাপেক্ষা অধিক উন্নতি করিতে পারে, এ ধারণা তিনি আদৌ অবিশ্বাস করেন নাই। সেই সঙ্গে আবার ভারতীয় আদর্শসমূহের চিরন্তন মূলমন্ত্রস্বরূপ এই কথাগুলিও আমাদের বলা হয়, “আধ্যাত্মিকতা সাংসারিকতা সহ্য করিতে পারে না।” ইহার প্রতিবাদস্বরূপ আমরা সুপরিচালিত, সুসংবদ্ধ জনকল্যাণরত সন্ন্যাসি-সঘগুলির উল্লেখ করিয়াছিলাম এবং প্রাচ্যের জনকয়েক জীর্ণবস্তু-পরিহিত, ঈশ্বরপ্রেমোন্মত্ত ভিক্ষুকের তুলনায় আমাদের বহু বহু মঠাধ্যক্ষ যাজক, মহাসাধিকা মঠাধ্যক্ষগণের উৎকর্ষতা দেখাইয়াছিলাম। তথাপি আমাদের স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে, এমনকি পাশ্চাত্যেও যখনই ধর্মবহ্নি সহসা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে, তখনই উহা প্রাচ্য আকার ধারণ করিয়াছে। কারণ, যাহারা মীরাবাঈ ও চৈতন্য, তুকারাম ও রামানুজের জন্মভূমি ভারতকে জানেন, তাহাদের পক্ষে আসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসকেও গৈরিকমণ্ডিত করিয়া দিবার লোভ সংবরণ করা কঠিন হইয়া পড়ে।