আপাত-প্রতীয়মান বহু স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরঙ্কুশ জীবন সত্ত্বেও কোন সন্ন্যাসীই স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় মনে প্রাণে সন্ন্যাসী ছিলেন না। তথাপি এই সেবাব্রতীর ক্ষেত্রে তিনি তাহাকে কোন মঠের চতুঃসীমার মধ্যে আবদ্ধ না রাখিয়া তাহার পরিবর্তে ভারতবাসিগণের মধ্যে অবস্থান করিয়া তাহাদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। আমার নিকট সময়ে সময়ে ইহাই তাহার প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছে। একবার তিনি বলেন, “আমাদের সকল লোকের সঙ্গে তাদের নিজের ভাব বজায় রেখে কথা বলতে হবে।” এই বলিয়া তিনি কল্পনা-সহায়ে বর্ণনা দিতে লাগিলেন, হয়তো ভবিষ্যতে ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গৈরিকধারী, নগ্নপদ ও অতি কঠোর-তপস্যারত ভারতীয় সন্ন্যাসী-সঙ্ঘের কোন সম্প্রদায় সর্বদা এই চরম সত্য ঘোষণা করিবে যে, সকল ধর্মই পরস্পরের সহিত সম্বদ্ধ।
যাহা হউক, এই ভারতীয় চেতনা আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে তাহার আদর্শ কায়মনোবাক্যে ঐরূপ কামনা করার মধ্যেই কেবল নিহিত ছিল না। ইউরোপে সাধারণতঃ কোন ধর্মসম্প্রদায়ের নব শিক্ষার্থীকে যেভাবে শিক্ষাদান করা হয়, সেইভাবে তিনি ধাপে ধাপে তন্ন তন্ন করিয়া হিন্দু আচার ব্যবহার সম্পর্কে বিশদভাবে উপদেশ দিতেন। এই উপায়ে তিনি প্রাচ্যবাসীর নিকট অতিশয় অমার্জিত বলিয়া প্রতিভাত পাশ্চাত্যের আদবকায়দার সদা অস্থিরভাব ও সকল বিষয়ে জোর দিয়া বলার অভ্যাস দূর করিতে প্রয়াস পান। কষ্ট, প্রশংসা অথবা বিস্ময়—যে কোন মনোভাব সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করিয়া ফেলা তাহার নিকট অত্যন্ত বিসদৃশ বলিয়া বোধ হইত। ইহাকে অধর্মরূপে চিহ্নিত করা নিম্প্রয়োজন কারণ উহা কুশিক্ষার ফল। প্রাচ্যবাসী এই প্রত্যাশা করেন যে, প্রত্যেকের অন্তরে অনুভূতি থাকা উচিত, কিন্তু ঐ ভাব অন্তরেই চাপিয়া রাখিতে হইবে। দিবারাত্র কোন কৌতূহলোদ্দীপক অথবা সুন্দর বস্তু দৃষ্টিতে পড়িলেই তাহা তৎক্ষণাৎ দেখাইয়া দেওয়া, তিনি চিন্তার নিভৃতভাব ও স্বচ্ছন্দগতির অনধিকার বাধাস্বরূপ মনে করিতেন। তথাপি তাহার মনোমত আচরণ বা আদবকায়দার সেই শান্তভাব যে একটা নিষ্ক্রিয় অবস্থামাত্র নহে, তাহার নিদর্শন জনৈক সাধুর প্রত্যুত্তরে পাওয়া যায়। “ঈশ্বরের স্বরূপ কি?” রাজার বারংবার এই প্রশ্নের উত্তরে সাধু বলেন, “রাজা, এতক্ষণ ধরে তার স্বরূপ কি—তাই তো আমি তোমাকে বলছিলাম। কারণ, মৌনই তার স্বরূপ!”
এই বিষয়ে তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা। ইউরোপীয় শিষ্যের প্রতি তিনি দীর্ঘকালব্যাপী কঠোর সংযমের আদেশ দিতেন। একবার কোন ঘটনা উপলক্ষে তিনি বলিয়াছিলেন, “ভাবোচ্ছাসের নামগন্ধ না রেখে আত্মানুভূতির চেষ্টা কর।”
একবার শরৎকালের এক নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় বৃক্ষ হইতে জীর্ণপত্ৰসমূহ পড়িতে দেখিয়া তিনি অস্বীকার করেন নাই যে, দৃশ্যটির মধ্যে কবিত্ব আছে, কিন্তু বলেন, বাহ্য ইন্দ্রিয়জগতের সামান্য একটি ঘটনা হইতে উদ্ভূত মানসিক উত্তেজনা নিতান্তই ছেলেমানুষি এবং অশোভন। তিনি আরও বলেন, পাশ্চাত্যবাসীকে অনুভূতি ও ভাবোচ্ছস এই দুইটি বস্তুকে পৃথক রাখিবার মহাশিক্ষা লাভ করিতে হইবে। “গাছের পাতাগুলো ঝরছে দেখে যাও, কিন্তু এই দৃশ্য দেখে যে ভাবের উদ্রেক হয়, তা পরে কোন সময়ে নিজের অন্তর থেকে সংগ্রহ কর।”
ইহা অবিকল সেই ইউরোপের মঠসমূহে প্রচলিত নীতি—যাহা শান্ত ও সংযতভাব বলিয়া পরিচিত। ইহাকে কি আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশের এক সূন উপায় বলা যায়? অথবা উহা এমন এক কবিত্বের সূচনা নির্দেশ করে—যাহা জগৎকে এক বিরাট প্রতীক বলিয়া মনে করিলেও বিচার বুদ্ধিকে ইন্দ্রিয়রাজ্যের বহু ঊর্ধে আসন প্রদান করে?
প্রশ্নটিকে শুধু সৎশিক্ষা ও সংযম অভ্যাসের রাজ্যের বাহিরে লইয়া গিয়া স্বামীজী কেবল ধর্মজীবনে ঐ সত্যের প্রয়োগ করিয়াও দেখিয়াছিলেন। সেইজন্য সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক বিচার-প্রসূত সুখলিঙ্গাকেও তিনি ভয়ঙ্কর বন্ধন বলিয়া জ্ঞান করিতেন এবং ঐভাবে বর্ণনা করিতেন। স্বামীজী বলিতেন, সকল আদর্শের ক্ষেত্রেই একটি বিপদের আশঙ্কা আছে, তাহা হইল, আমরা যতটুকু নিজে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি, তাহাকেই আদর্শ বলিয়া মনে করা। উহা কেবল শবের উপর একরাশ ফুল চাপা দেওয়া, এবং কার্যে পরিণত হইলে উহার অর্থ দাঁড়ায়—শীঘ্র অথবা বিলম্বে হউক, জনসাধারণের পক্ষ পরিত্যাগ এবং তাহাদের উন্নতিকল্পে আর কার্যের বিনাশ। তাহারাই কেবল বিশ্বস্ত, যাহারা প্রলোভনের অতীত এবং সম্পূর্ণরূপে অহংবর্জিত হইয়া কেবল শুদ্ধ ভাবের অনুগামী।
ভাবী কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করিতে করিতে তিনি বলিলেন, “সাবধান! উত্তম আহার, পরিচ্ছদ—এ সকলের প্রতি মনোযোগ দিও না। সংসারে বাইরের চাকচিক্যে মুগ্ধ হলে চলবে না। ওসব একেবারে পরিত্যাগ করা চাই। মূলসমেত উপড়ে ফেলতে হবে। এ কেবল ভাবুকতা—ইন্দ্রিয়ের অসংযম থেকেই এর উৎপত্তি। বিচিত্র বর্ণ, সুন্দর দৃশ্য ও শব্দ এবং অন্যান্য সংস্কার অনুযায়ী এইসব উচ্ছাস মানুষের কাছে উপস্থিত হয়। এসব দূর কর। ঘৃণা করতে শেখ। এটা একেবারে বিষ!”
এইরূপে হিন্দু গৃহস্থালীর সাধারণ দৈনন্দিন কর্তব্যগুলি স্বামীজীর বর্ণনায় রাশি রাশি গভীরতর তথ্যের উদ্বোধক হইয়া দাঁড়াইত—যাহা কেবল হিন্দু মনেরই সহজবোধ্য। তিনি নিজে আশৈশব সন্ন্যাসী-সঙ্ঘ-পরিচালনা সম্পর্কে জানিতে উৎসুক ছিলেন। এক সময়ে একখানি ঈশা-অনুসরণ (Imitation of Christ) পুস্তক ঠাহার হস্তগত হয়; উহার মুখবন্ধে উক্ত গ্রন্থের আনুমানিক রচয়িতা আঁা-দ্য-জের্স (Jean de Gerson) যে মঠভুক্ত ছিলেন ঐ মঠ এবং যে নিয়মগুলি তিনি অনুসরণ করিতেন, তাহার বর্ণনা ছিল। স্বামীজীর কল্পনায় উক্ত মুখবন্ধ ছিল পুস্তকটির রত্নস্বরূপ। বার বার পাঠ করিয়াও তাঁহার তৃপ্তি হয় নাই; ক্রমে উহা তাহার কণ্ঠস্থ এবং বাল্যকালের স্বপ্নের সহিত বিশেষভাবে জড়িত হইয়া যায়। অবশেষে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হইয়া বিস্ময়ের সহিত দেখিলেন যে, তিনি স্বয়ং ভাগীরথীতীরে এক সন্ন্যাসীসঙ্ঘ স্থাপন করিতেছেন, এবং হৃদয়ঙ্গম করিলেন যে, তাহার শৈশবের ঐকান্তিক অনুরাগ ভাবী জীবনের পূর্ব ছায়াপাত মাত্র।