কোন একটি প্রথা শিক্ষা দিবার সঙ্গে তাহার অন্তর্নিহিত আদর্শ দেখাইয়া দিবার অসাধারণ ক্ষমতা স্বামীজীর ছিল। আজ পর্যন্ত ফু দিয়া আলো নেবানো মহা অপবিত্র ও অসভ্যজনোচিত কার্য ভাবিয়া আমরা শিহরিয়া উঠি, আবার শাড়ি পরা ও অবগুণ্ঠন দ্বারা মস্তক আবৃত করার অর্থ অভিমান ও হামবড়া ভাবের পরিবর্তে সর্বদা নম্ন-মধুরভাবে সকলকে মানিয়া চলা—এ-সকল বাহ্য ব্যাপার কত পরিমাণে এক একটি আদর্শের অভিব্যক্তি বলিয়া ভারতের সর্বসাধারণের পরিচিত, পাশ্চাত্যবাসী আমরা হয়তো যথার্থভাবে বুঝিয়া উঠিতে পারি না। অবগুণ্ঠন সম্পর্কে স্বামী সদানন্দ একবার আমাকে বলেন, “কখনো ওটা টেনে দিতে ভুলো না। মনে রেখো, আদর্শ পবিত্র জীবনের অর্ধেক ঐ শ্বেত অবগুণ্ঠনের মধ্যেই নিহিত।”
এই-সকল বিষয়ে স্বামীজী শিষ্যকে সেই পথেই পরিচালিত করিতেন, যে পথ শিষ্য ইতোমধ্যেই সঠিক বলিয়া জানিয়াছেন। যদি তাহাকে ভারতীয় শিক্ষাসংক্রান্ত কোন সমস্যার সমাধান করিতে হয়, তাহা হইলে প্রথমে নিম্নস্তরের শিক্ষাদান-প্রণালীর অভিজ্ঞতালাভ তাহার পক্ষে অপরিহার্য; এবং এই কার্যের জন্য সর্বোচ্চ ও অত্যাবশ্যক গুণ হইল, ছাত্রের দৃষ্টিতে জগৎকে দেখা—যদি একমুহূর্তের জন্য হয়, তাহাও স্বীকার। শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রত্যেকটি নিয়ম এই কথাই ঘোষণা করে। যাহারা ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া জগৎকেদেখিতে জানেন না, অথবা কোন্ অভীক্ষিত উদ্দেশ্যসাধনে সহায়তা করিতে হইবে, তাহা জ্ঞাত নহেন, তাহার নিকট ‘জ্ঞাত হইতে অজ্ঞাত বস্তুতে’, ‘সরল হইতে জটিল তত্ত্বে’, ‘স্থূল হইতে সূক্ষ্মে’ কথাগুলি, এমনকি, ‘শিক্ষা’ শব্দটি পর্যন্ত কেবল মুখের কথায় পর্যবসিত হয়। ছাত্রের স্বাভাবিক ইচ্ছার প্রতিকূলে শিক্ষাদান হিতসাধনের পরিবর্তে অনিষ্টকরই হয়।
স্বামীজীর শিক্ষাদানের মধ্যে তাঁহার এই সহজাত ধারণাই বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করিত যে, ভারতীয় চেতনা ভারতীয় দৈনন্দিন জীবনে সহস্র খুঁটিনাটি ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত। একটু ভাল করিয়া দেখিলে বুঝিতে পারা যায় যে, শ্রীরামকৃষ্ণও এই প্রণালী অবলম্বন করিয়াছিলেন। যখনই তাহার কোন নূতন ভাব উপলব্ধি করিবার আকাঙক্ষা হইত, তিনি উক্ত মতাবলম্বীদের আহার, পরিচ্ছদ, ভাষা এবং সাধারণ চালচলন গ্রহণ করিতেন। কয়েকটি ধর্মমতের ব্যাপারেই শুধু তাহাদের সদৃশ হইবার প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত হইতেন না।
কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় একজন মহান শিক্ষক এই সকল ব্যাপারেও শিষ্যের স্বাধীনতা অবহেলা করিতে পারিতেন না। উদ্দেশ্যটি একটু একটু করিয়া উদঘাটিত হইত, এবং সর্বদাই শিষ্য ইতোমধ্যে যাহা আয়ত্ত করিয়াছে, তাহারই সহায়তায় তাহাকে অগ্রসর করিয়া দিতেন। ইহা সত্য যে, তিনি সর্বদা তাহার নিজের ও অপর সকলের কর্মে প্রবৃত্ত হইবার উদ্দেশ্যটি বিশুদ্ধ কিনা, তাহা পরীক্ষা করিতেন, এবং সর্বদা সতর্ক থাকিতেন যাহাতে বিন্দুমাত্র স্বার্থ উহাতে প্রবেশ না করে। তিনি বলিতেন, “আমি কাউকে বিশ্বাস করি না, কারণ, আমি নিজেকেই বিশ্বাস করি না। কে জানে কাল আমি কি হব?” কিন্তু তিনি নিজে একবার যেমন বলিয়াছিলেন, তাহাও সত্য যে, অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল—এমনকি, ভুলের সম্ভাবনা দূর করিবার জন্যও নহে। ভুল ঘটিয়া যাইবার পরই কেবল তিনি উহার কারণ প্রদর্শন করিতেন তাহার পূর্বে নহে।
১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দের প্রথম ছয়মাস আমি মধ্যে মধ্যে কলিকাতার নানা শ্রেণীর দেশীয় ও ইউরোপীয় ব্যক্তিগণের গৃহে আহারাদি করিতাম। স্বামীজী ইহাতে অস্বস্তিবোধ করিতেন। সম্ভবতঃ তাঁহার আশঙ্কা ছিল, ইহা দ্বারা নিষ্ঠাবান হিন্দুজীবনের অত্যধিক সরলতার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জন্মিতে পারে। একথাও তিনি নিঃসন্দেহে ভাবিয়াছিলেন যে, ইহাতে আজন্মসঞ্চিত সংস্কারসমূহের দ্বারা আমার পুনরায় আকৃষ্ট হইবার সম্ভাবনা আছে। পাশ্চাত্যে তিনি এক বিরাট ধর্মান্দোলনকে জনৈক অতিরিক্ত রুচিসম্পন্ন মহিলার তুচ্ছ সামাজিক উচ্চাকাঙাহেতু ধূলিসাৎ হইতে দেখেন। তথাপি তিনি এ-বিষয়ে আমাকে বিন্দুমাত্র বাধা দেন নাই, যদিও তাঁহার মুখনিঃসৃত একটি আদেশবাক্যই যে কোন সময়ে উহা বন্ধ করিয়া দিতে পারিত। ইহা যে তাহার মনঃপূত নয়, একথাও কখনও প্রকাশ করেন নাই। উপরন্তু কেহ নিজের কোন অভিজ্ঞতা তাহার দৃষ্টিগোচর করিলে তিনি আগ্রহসহকারে তাহা শ্রবণ করিতেন। রাজসিক আহার সম্পর্কে তাহার আশঙ্কা সাধারণভাবে প্রকাশ করিতেন, অথবা উহা দ্বারা অনিষ্ট হইবে বলিয়া গম্ভীর সাবধানবাণী উচ্চারণ করিতেন—যাহার অর্থ ঐ সময় আমাদের হৃদয়ঙ্গম হইত না। কিন্তু বর্তমান ভারতে যে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও স্বার্থ রহিয়াছে, তাহাদের সমন্বয় দৃষ্টিতে ধারণা করা আমার পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়, সম্ভবতঃ ইহা উপলব্ধি করিয়াই তিনি সম্পূর্ণরূপে শিষ্যের মত সমর্থন করিয়া তাহাকে স্বাধীনভাবে তত্ত্ব অন্বেষণে অনুমতি দেন।
ইংলণ্ড-যাত্রারম্ভের পর জাহাজেই তিনি নিজ সঙ্কল্পিত আদর্শ সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করেন। স্ত্রী-শিক্ষা কার্যের ভবিষ্যৎ আলোচনা-প্রসঙ্গে তিনি একদিন বলেন, “তোমাকে লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ একেবারে ছাড়তে হবে, এবং রীতিমত নির্জনবাস করতে হবে। তোমার চিন্তা, প্রয়োজন, ধারণা, অভ্যাস—এসব হিন্দুভাবাপন্ন করে তুলতে হবে। তোমার জীবন হবে ভেতরে বাইরে যথার্থ নিষ্ঠাবতী হিন্দু ব্রাহ্মণ-ব্রহ্মচারিণীর মতো। এর সাধনের উপায় তুমি নিজে থেকেই জানতে পারবে, যদি যথেষ্ট আগ্রহ থাকে। কিন্তু অতীত জীবন তোমাকে একেবারে ভুলতে হবে, এবং অপরেও যাতে ভুলে যায়, দেখতে হবে। তার স্মৃতি পর্যন্ত ত্যাগ করতে হবে।”