আমার বরাবর বিশ্বাস, এইরূপ এক বিপর্যয় ও ভীতির যুগে জনসাধারণকে পরিচালনা করিবার ও প্রকৃতিস্থ রাখিবার জন্যই আমাদের আচার্যদেব ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনে শক্তিপূজার এক মহান উদ্বোধন ঘোষিত হইয়াছে। জগন্মাতাই একাধারে এই বিপরীত চরমভাবের সময়স্থল। ভালমন্দ উভয়ের মধ্যেই তাঁহার প্রকাশ ঘটে। সকল পথের গন্তব্যস্থল তিনিই। যখনই স্বামীজী সুর সংযোগে মাতৃপ্রণামের মন্ত্র আবৃত্তি করিতেন, আমরা যেন একটি মাত্র কোমল কণ্ঠস্বরের পশ্চাতে বহু যন্ত্রসহযোগে উখিত মৃদু সঙ্গীতের ন্যায় ঐতিহাসিক নাটকের এই মহান সমবেত সঙ্গীত শুনিতে পাইতাম। তিনি আবৃত্তি করিতেন?
“যা শ্ৰীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেধলক্ষ্মীঃ।
পাপাত্মনাং কৃতধিয়াং হৃদয়েষু বুদ্ধিঃ ॥
শ্রদ্ধা সতাং কুলজনপ্ৰভবস্য লজ্জা।
তাং ত্বাং নতাঃ স্ম পরিপালয় দেবি বিশ্বম্ ॥”(২)
অতঃপর যেন এক সাধারণ আশা ও ভয়ে উৎপীড়ক ও উৎপীড়িতের একত্র সম্মিলন, সেনাসমূহের সগর্ব পদসঞ্চার এবং বিভিন্ন জাতির সংক্ষোভ মানসকর্ণে উচ্চতর ও স্পষ্টতরভাবে ধ্বনিত হইতে লাগিল, অমনি ঐ সকলের ঊর্ধ্বে সেই মহাস্তোত্রের বজ্রনির্ঘোষ শ্রুতিগোচর হইল :
“প্ৰকৃতিত্ত্বংহি সর্বস্য গুণত্রয়বিভাবিনী।
কালরাত্ৰিৰ্মহারাত্রিমোহরাত্রিশ্চ দারুণা।” (৩)
“সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণি নমোহস্তু তে ॥ (৪) ————
১ Bashi-Bazouks—ইহারা খলিফাদের শরীর-রক্ষক ছিল। বহু শতাব্দী ধরিয়া তুর্কী রক্ষীদলে যে-সকল সৈনিককে নিযুক্ত করা হইত, তাহাদের শৈশবে সকল দেশ ও জাতির মধ্য হইতে অপহরণ করিয়া আনা হইত ও ইসলামধর্মে দীক্ষিত করিয়া লালন-পালন করা হইত। এইরূপে তাহাদের ধর্মে অতিশয় অনুরাগ এবং দেশের ও রাজার সেবাই পরস্পরের মধ্যে একমাত্র বন্ধনস্বরূপ ছিল। সমগ্র ইউরোপে তাহারা হিংস্ৰপ্রকৃতি ও সাহসী বলিয়া বিখ্যাত ছিল। মিশরে নেপোলিয়ান তাহাদের ক্ষমতা চূর্ণ করেন।
২ যিনি সুকৃতিগণের ভবনে স্বয়ং লক্ষ্মী, আবার পাপাত্মাদিগের গৃহে অলক্ষ্মী, যিনি নির্মলচিত্ত ব্যক্তিগণের হৃদয়ে বুদ্ধি, যিনি সাধুদিগের শ্রদ্ধা ও সৎকুলজাত ব্যক্তিগণের লজ্জাস্বরূপ, সেই তোমাকে আমরা প্রণাম করিতেছি। হে দেবি. বিশ্বকে প্রতিপালন কর।—চণ্ডী ৪/৫
৩ তুমি সকলের গুণত্রয়প্রকাশকারিণী প্রকৃতি, তুমি গভীর প্রলয় রাত্রি, মরণরূপ রাত্রি এবং দারুণ মোহরাত্রি।–ঐ, ১/৭৮
৪ সকল মঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপে, হে শিবে, হে সর্বাভীষ্টসিদ্ধিকারিণি হে শরণাগত রক্ষয়িত্রি, হে ত্রিনয়নি, গৌরি, নারায়ণি, তোমাকে নমস্কার।—ঐ, ১১/১০
২১. পাশ্চাত্য সেবাব্রতীকে শিক্ষাদান-প্রণালী
স্বামীজী একবার গাজীপুরের পওহারী বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, ”কাজে সফলতার রহস্য কি?” এবং তিনি এই উত্তর লাভ করেন, “জৌন সাধন তৌন সিদ্ধি”—যাহা সাধন, তাহাই সিদ্ধি, অর্থাৎ সাধন বা উপায়গুলিকে সাধ্য বা উদ্দেশ্যের ন্যায় জ্ঞান করিতে হইবে।
এই উক্তির প্রকৃত অর্থ লোকে কালেভদ্রে ক্ষণেকের জন্য হৃদয়ঙ্গম করে। কিন্তু যদি ইহার অর্থ এই হয় যে, সাধকের সমগ্র শক্তি উপায়গুলির উপরেই কেন্দ্রীভূত হওয়া চাই—যেন উহারাই উদ্দেশ্য এবং সেই সময়ের জন্য প্রকৃত উদ্দেশ্য বিস্মৃত হইতে হইবে, অথবা উপেক্ষা করিতে হইবে—তাহা হইলে গীতার সেই মহতী শিক্ষারই উহা প্রকারান্তর মাত্র হইয়া দাঁড়ায়, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন”-কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নহে।
আমাদের আচার্যদেব তাহার শিষ্যগণকে এই আদর্শের অভ্যাসপ্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করিবার রহস্য অদ্ভুত রকমে জানিতেন। তিনি মনে করিতেন, যদি কোন ইউরোপীয় তাঁহার মতানুযায়ী ভারতের জন্য কার্যকরেন, তবে তাহাকে উহা ভারতীয় প্রণালীতেই করিতে হইবে। স্বামীজীর এই ধারণার পশ্চাতে তাহার নিজস্ব যুক্তি ছিল, এবং হয়তো প্রত্যেক ভারতবাসী উহা বুঝিতে পারিবেন। এই দাবির মধ্যে একদিকে যেমন তিনি মুখ্য ও গৌণ বিষয়গুলিকে কদাপি মিশাইয়া এক করিয়া ফেলেন নাই, তেমনি অপরদিকে সামান্য তুচ্ছ ব্যাপারও তিনি কম গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করিতেন না। যেসব খাদ্য শাস্ত্রসম্মত, কেবল তাহাই আহার এবং উহা আবার হাত দিয়া খাওয়া, মেঝের উপর উপবেশন ও শয়ন, হিন্দুর সকল আচার-অনুষ্ঠান পালন, এবং হিন্দুর দৃষ্টিতে যাহা শিষ্টাচার বলিয়া গণ্য, তাহার যথাযথ পালন ও সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ
এই সকলের প্রত্যেকটি তাহার মতে ভারতীয় চেতনা আয়ত্ত করিবার উপায়স্বরূপ, যাহার ফলে অতঃপর কোন বিদেশী জীবনের বৃহত্তর সমস্যাগুলির সমাধান ভারতীয়ভাবে বুঝিতে অভ্যস্ত হইবেন। অতি তুচ্ছ ব্যাপার, যেমন সাবানের পরিবর্তে বেসন ও লেবুর রস ব্যবহার—তাহার নিকট প্রণিধানযোগ্য ও করণীয় বলিয়া বোধ হইত। এমনকি, জাতিভেদ সম্পর্কে যে চিরপোষিত ধারণা অত্যন্ত অমার্জিত বলিয়া বোধ হইত, তাহাও সমর্থন ও আত্মসাৎ করিয়া লইতে হইবে। স্বামীজী যেন অন্তর হইতে বুঝিয়াছিলেন, হয়তো এমন দিন আসিবে, যখন লোকে তাহারই মতো ঐ সকল ধারণার পারে চলিয়া যাইবে; কিন্তু কোন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া ঐ প্রকার ধারণা হইতে মুক্তিলাভ এবং অন্ধতাবশতঃ উহার প্রতি উপেক্ষা অথবা অজ্ঞতা প্রদর্শন—এই উভয়ের মধ্যে কত প্রভেদ।