তিনি পরিষ্কাররূপে বুঝিয়াছিলেন, ভারতের শ্রমজীবিগণকে শিক্ষা দেওয়া প্রকৃতপক্ষে ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায়েরই কার্য, অপর কাহারও নহে। বিদেশী কর্তৃক বিদেশজাত জ্ঞানের প্রবর্তনে যে অশেষ বিপদের সম্ভাবনা, তাহা মুহূর্তে জন্যও তাহার নিকট গোপন ছিল না। অধুনা প্রকাশিত তাহার পত্রগুলিতে তিনি যে ক্রমাগত ছাত্রগণকে ম্যাজিক লণ্ঠন, ক্যামেরা এবং রাসায়নিক পরীক্ষার উপযোগী কিছু কিছু উপকরণ লইয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া শিক্ষা প্রদানের যুক্তি দেখাইতেছেন–ইহাই তাহার অর্থ। আবার, সাধুরা যখন মাধুকরী করিতে গিয়া নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণের সহিত মেলামেশা করেন, তখন তাহারা যেন কিছু কিছু ঐহিক শিক্ষাও তাহাদের প্রদান করেন, এজন্যও তিনি অনুরোধ জানান। অবশ্য এ সমস্তই হইবে নবশিক্ষার সহায়ক ও প্ররোচনামাত্র। সেই প্রকৃত শিক্ষার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে একাকী অথবা সম্মিলিতভাবে প্রাণপণ চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, এক বৃহৎ জাতিকে, তাহার বোধসীমার বাহিরে অবস্থিত এক চিন্তা ও জ্ঞানের রাজ্য সম্পর্কে অবহিত করাই নূতন শিক্ষাকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার করিবার প্রথম সোপান। সুতরাং এই ধরনের নানা পরিকল্পনা স্বামীজীর পক্ষে খুবই সঙ্গত হইয়াছিল।
কিন্তু ধর্মাচার্যের উপযুক্ত যে কার্যের সূত্রপাত এবং মাহাত্ম্য তিনি স্বয়ং প্রচার করিয়া গিয়াছেন, অধিকাংশ স্থলেই তাহা ছিল ক্ষুধার্ত অথবা পীড়িতের বিশেষ সেবা। ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দে প্লেগনিবারণকল্পে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক প্রথম যে স্বাস্থ্য-সংরক্ষণ কার্য আরম্ভ হয়, তাহার জন্য অর্থ স্বামীজীই সংগ্রহ করিয়া দেন। ঐ কার্য আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। পাশ্চাত্যদেশে কয়েক বৎসর অবস্থান কালে তিনি সর্বদা এমন কর্মিগণের সন্ধানে থাকিতেন, যাহারা ভারতের অন্ত্যজদের সেবাকার্যে নিজেদের উৎসর্গ করিবে, এবং ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে হার ব্রাহ্মণ শিষ্যগণকে নীচজাতীয় কলেরারোগীর সেবায় নিরত দেখিয়া তিনি যেরূপ আনন্দে উৎফুল্ল হইয়াছিলেন, এমন আব কিছুতেই নহে। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, “পূর্বে বুদ্ধের সময় যা ঘটেছিল, তা আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণ তাহার প্রেম ও করুণাপ্রসূত সর্বশেষ সন্তানপ্রতিম কাশীর ক্ষুদ্র সেবাশ্রমটির প্রতি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা ও প্রীতি অনুভব করিয়া থাকেন।
বিশেষভাবে কেবল শিক্ষারই সহিত সংশ্লিষ্ট—এইরূপ কার্যের সহিত তাহার সাক্ষাৎ সম্বন্ধ না থাকিলেও তাহাদের প্রতি তাহার হৃদয় কম আকৃষ্ট হইত না। যে-সকল মাসিকপত্রের সহিত রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অল্পবিস্তর সম্পর্ক ছিল, তাহাদের হিতাহিত এবং মুর্শিদাবাদ অনাথাশ্রম হইতে প্রদত্ত শিল্পশিক্ষা তাহার দৃষ্টিতে বরাবর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া গণ্য হইত। ভারতের বর্তমান অবস্থায় মাসিকপত্রগুলি বহুস্থলে একাধারে ভ্রাম্যমাণ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বলিলেই চলে। তাহাদের প্রভাব অদ্ভুত। উহারা একদিকে যেমন ভাব বিস্তার করে, অপরদিকে তেমন লোকের মনোভাব ব্যক্ত করিবার যন্ত্রস্বরূপ হয়। সহজাত সংস্কারপ্রভাবে স্বামীজী ইহাদের শিক্ষাসংক্রান্ত উপকারিতা উপলব্ধি করেন এবং সেজন্যই তাহার গুরুভ্রাতা ও শিষ্যগণ কর্তৃক পরিচালিত মাসিকপত্রিকাগুলির ভাগ্য সম্পর্কে তিনি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কোন সাময়িক পত্রের একই সংখ্যায় হয়তো একপৃষ্ঠায় উচ্চতম অতীন্দ্রিয় তত্ত্বসমূহ এবং অপর পৃষ্ঠায় অপেক্ষাকৃত কাঁচা হাতের লেখা নানা ঐহিক বিষয়ের জল্পনা-কল্পনা স্থান পাইত, এবং ইহা দ্বারা ভারতের যুগ সন্ধিক্ষণে সাধারণ লোকের মনের গতি কোন দিকে তাহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। এই আপাত-বিসংবাদের উল্লেখপূর্বক স্বামীজী স্বয়ং বলিয়াছেন, “হিন্দুদের ধারণা, ধ্যানের দ্বারা জ্ঞানলাভ হবে; বিষয়টি গণিতশাস্ত্র হলে ধারণাটি খাটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভূগোলের বেলায়ও তাদের স্বাভাবিক সংস্কার ঐ উপায় গ্রহণে প্রবৃত্ত করে; এবং একথা বলা নিম্প্রয়োজন যে ঐ উপায়ে ভূগোলের জ্ঞান বিশেষ হয় না।”
কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের করুণার উচ্ছ্বাস কেবল ভারতের জনসাধারণের প্রতিই প্রবাহিত হইত না। ব্যবসাতে অধিক মূলধন নিয়োগে অধিক লাভের সম্ভাবনা, এইরূপ মতাবলম্বীদের বিপক্ষে তিনি যাহারা অল্প জমিতে চাষ করে, অথবা স্বল্প পুঁজি লইয়া কৃষিজাত দ্রব্যের কারবার করে, সর্বদা তাহাদের সমর্থন করিতেন। উহা তাহার প্রাচ্য ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণের উপযুক্ত কার্যই হইত। তিনি বলিতেন, বর্তমানে যে মানবিকতার যুগের অভ্যুদয় ঘটিতেছে, তাহার প্রধান কার্য হইবে—শ্রমজীবিদের সমস্যার সমাধান, অথবা তিনি যেমন বলিতেন, শূদ্র-সমস্যার সমাধান। তাহার পত্র হইতে জানা যায়, যখন পাশ্চাত্যে তিনি প্রথম পদার্পণ করেন, তখন সেখানকার আপাত-প্রতীয়মান অধিকার-সাম্যের দ্বারা তিনি বিশেষ আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। পরবর্তী কালে ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে উহার অন্তরালে যে ধনতান্ত্রিক স্বার্থপরতা ও বিশেষ অধিকার লাভের জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম চলিতেছে, সে সম্বন্ধে তাহার পরিষ্কার ধারণা হয়, এবং চুপি চুপি একজনকে বলেন, পাশ্চাত্য জীবন এখন তাহার নিকট ‘নরক’ বলিয়া বোধ হইতেছে। পরিণত বয়সের বহু অভিজ্ঞতার ফলে তিনি যেন কতকটা বিশ্বাস করিতে চাহিতেন যে, অপেক্ষাকৃত কোন কোন আধুনিক দেশ অপেক্ষা চীন দেশই সর্বাপেক্ষা মানবিকনীতিজ্ঞান সম্পর্কে যে আদর্শ ধারণা—তাহার সমীপবর্তী হইতে পারিয়াছে। তথাপি, সমগ্র জগতে আগামী যুগ যে জনসাধারণের অথবা শূদ্রজাতির কল্যাণের কারণ হইবে, এ বিষয়ে তাহার কোন সন্দেহ ছিল না। একদিন তিনি বলিয়াছিলেন, “শ্রমিক সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর সংক্ষোভ, কী ভীষণ আলোড়নের মধ্য দিয়ে তা সংঘটিত হবে!” তিনি যেন ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করিয়া কথা বলিতেছিলেন; তাহার কণ্ঠে যেন ভবিষ্যদ্বাণী ঘোষিত হইতেছিল। শ্রোতা যদিও উৎসুকভাবে আরও কিছু শুনিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, তিনি কিন্তু নীরব হইয়া গেলেন, এবং ক্রমে গভীরতর চিন্তায় মগ্ন হইয়া গেলেন।