তিনি সানন্দে দেখাইয়া দিতেন যে, হিন্দুগণের চক্ষে লিখিত সকল শব্দই সমভাবে পবিত্র; সংস্কৃত যেরূপ, ইংরেজি ও পারসিক শব্দও সেইরূপ পবিত্র। কিন্তু বিদেশী আদবকায়দা ও বিদেশী শিক্ষাদীক্ষার বাহ্য চাকচিক্যের প্রতি তাহার ঘৃণা ছিল। কেবল বাহ্যবস্তুগুলির পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে যে-সব সমালোচনা, তাহার প্রতি তিনি আদৌ কর্ণপাত করিতে পারিতেন না। দুইটি সমাজের তুলনাকালে তিনি সর্বদা দেখাইয়া দিতেন যে, বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন আদর্শ বিকাশের প্রচেষ্টায় রত, এবং আধুনিককালে অথবা মধ্যযুগে হউক, এই লক্ষ্যসাধন অথবা আদর্শপ্রাপ্তির প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তিনি তাহাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার করিতেন।
সর্বোপরি, ভালবাসা সম্পর্কে তাহার ধারণা এরূপ ছিল যে, বক্তা ও যাহার সম্পর্কে বলিতেন, এই উভয়ের মধ্যে তিনি কোন ভেদ স্বীকার করিতেন না। অপরের সম্বন্ধে ‘তাহারা’ বলিয়া উল্লেখ তাহার নিকট প্রায় ঘৃণাতুল্য বোধ হইত। যাহারা সমালোচনা বা নিন্দার পাত্র, তিনি সর্বদা তাহাদের পক্ষ অবলম্বন করিতেন। যাহারা তাহার নিকট অবস্থান করিতেন, তাহারা বেশ বুঝিয়াছিলেন যে, যদি সত্যই জগৎকে ঈশ্বর ও শয়তান নামক দুই পৃথক ব্যক্তির সৃষ্টি বলিয়া মীমাংসা করা যাইত, তাহা হইলে তিনি নিজে ঈশ্বরের সেনাপতি আর্কেঞ্জেল মাইকেলের পক্ষ অবলম্বন না করিয়া, যাহার উপর ঈশ্বর জয়ী হইয়াছেন, সেই চিরকালের জন্য পরাজিত শয়তানেরই পক্ষ গ্রহণ করিতেন। তিনি শিক্ষা বা সাহায্যদানে সমর্থ, এই প্রকার দৃঢ় বিশ্বাস হইতে তাহার এই ভাব উৎপন্ন নহে, পরন্তু কেহ যে চিরদিনের মতো দুঃসহ ক্লেশতভাগে বাধ্য হইতেছে, তাহারই দুঃখের অংশ গ্রহণ করিবার জন্য আন্তরিক দৃঢ়সঙ্কল্প হইতে উদ্ভূত। চিরকালের মতো কেহ নিদারুণ দুঃখে পতিত হইয়াছে দেখিলে, তাহার সকল কষ্ট নিজে গ্রহণ করিয়া প্রয়োজন হইলে বিশ্বের সমগ্র শক্তি অগ্রাহ্য করিবার জন্য তিনি প্রস্তুত থাকিতেন।
তাহার প্রকাশিত কয়েকখানি পত্রে দেখাইয়া দিয়াছেন যে, দয়ারূপ ভিত্তির উপরেও মানবসেবাব্রতকে যাথার্থরূপেস্থাপন করা যায় না। তাহার পক্ষে ঐরূপ বলা নিতান্ত স্বাভাবিক, কারণ ঐ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার তিনি আদৌ পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বলেন, অপরকে জীবজ্ঞানে সাহায্য করাকেই ‘দয়া বলিয়া অভিহিত করা হয়; কিন্তু প্রেম’ আত্মা জ্ঞান করিয়া সকলের সেবায় রত হয়। অতএব প্রেমই পূজাস্বরূপ, এবং এই পূজাই ঈশ্বরদর্শনে পরিণত হয়। সুতরাং অদ্বৈতবাদীর পক্ষে প্রেমই একমাত্র কার্যে প্রবৃত্ত হওয়ার হেতু।” কোন উচ্চ সেবার ভার প্রাপ্তির সহিত অপর কোন প্রকার উচ্চ অধিকারের তুলনা হইতে পারে না। এক পত্রে তিনি বলিয়াছেন, “যিনি কাহাকেও রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, তাঁহারই আনন্দিত হইবার কথা, যাহাকে রক্ষা করা হইয়াছে, তিনি নহেন।” মন্দিরে পূজা করিবার সময় পুরোহিতগণকে যেরূপ বাহ্যান্তরশুদ্ধি করিয়া উৎসুকভাবে অথচ সম্ভ্রমের সহিত সকলপ্রকার বাধাবিপত্তির মধ্যে অবিচলিত থাকিবার দৃঢ়সঙ্কল্প লইয়া পূজায় প্রবৃত্ত হইতে হয়, স্ত্রীশিক্ষারূপ পবিত্র কার্যসাধনে যাহারা মনোনীত হইয়াছেন, তাহাদের ঐরূপ মনোভাব লইয়া কার্যে অবতীর্ণ হওয়া প্রয়োজন। কলিকাতা মহাকালী পাঠশালার স্থাপয়িত্ৰী মহারাষ্ট্র মহিলা মাতাজী মহারানীর কথাগুলি স্বামীজী মনে রাখিয়াছিলেন এবং প্রায়ই উল্লেখ করিতেন। যে ছোট ছোট মেয়েগুলিকে তিনি পড়াইতেন, তাহাদের দেখাইয়া তিনি বলিয়াছিলেন, “স্বামীজী, আমার কোন সহায় নেই। কিন্তু আমি এই পবিত্র কুমারীদের পূজা করি; তারাই আমাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে।”
জনসাধারণ বা নিম্নশ্রেণীর লোক বলিয়া যাহারা অভিহিত, তাহাদের প্রতি তাহার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ঐ প্রকার প্রগাঢ় সহানুভূতি ও সেবার ভাব প্রকাশ পাইত। সমাজের উচ্চশ্রেণীর ভ্রাতাদের ন্যায় এই নিম্নশ্রেণীদেরও বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানলাভে সম অধিকার আছে। এই শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ করিলেই তাহারা স্বাধীনভাবে নিজেরাই তাহাদের ভাগ্য নির্ণয় করিতে পারিবে। এই কার্যসাধন সম্পর্কে চিন্তাপূর্বক স্বামীজী কেবল বুদ্ধ হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতের মহান লোকশিক্ষকগণের পদাঙ্কই অনুসরণ করিতেছিলেন। যে যুগে উপনিষদের দর্শন একমাত্র আদিগের বিশেষ অধিকার বলিয়া গণ্য হইত, সেই যুগে ভগবান তথাগত আবির্ভূত হইয়া জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলকে ত্যাগের দ্বারা নির্বাণলাভরূপ শ্রেষ্ঠ মার্গের উপদেশ করেন। যে দেশে এবং যে যুগে সিদ্ধ আচার্যগণ প্রদত্ত মন্ত্র কেবল অতি অল্প সংখ্যক সুশিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে সযত্নে রক্ষিত হইত, সেখানে আচার্য রামানুজ কাঞ্চনগরীর গোপুর হইতে সেই সকল মহামন্ত্র পারিয়া বা চণ্ডালদের নিকট ঘোষণা করেন। ভারতে এখন আধুনিক যুগের অভ্যুদয়; ঐহিক জ্ঞান দ্বারা মনুষ্যত্বলাভের উদ্বোধন কাল। সুতরাং স্বভাবতই স্বামী বিবেকানন্দের নিকট সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, কিরূপে জনসাধারণের মধ্যে ঐহিক জ্ঞান বিস্তার করা যায়।
অবশ্য তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন যে, ভারতে ঐহিক উন্নতির পুনঃপ্রবর্তনের জন্য প্রয়োজন সমগ্র জাতির শক্তি ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আর তিনি বেশ জানিতেন যে, ঐহিক সম্পদের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই সর্বাগ্রে একান্ত আবশ্যক। তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ওজস্বিতার সহিত তিনি বলিয়াছিলেন,”যে ঈশ্বর আমাকে ইহ জীবনে একটুকরা রুটি দিতে পারেন না, পরজীবনে তিনি আমাকে স্বর্গরাজ্য দেবেন, একথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। সম্ভবতঃ তিনি আরও উপলব্ধি করেন যে, একমাত্র জ্ঞানবিস্তার দ্বারাই সমগ্র দেশ তাহার বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির মহান উত্তরাধিকারের প্রতি নিজ শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ণ বাখিতে পারিবে। যে ভাবে হউক, একমাত্র গণতন্ত্রের অভ্যুত্থানের জন্য বিরাট আন্দোলনের দ্বারাই সমাজের উচ্চশ্রেণীর ধমনীতে নবজীবনের সঞ্চার সম্ভব। তাহার বিশ্বাস ছিল,উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ করিলেই নেতৃত্বের সনদ লাভ হইবে এই প্রকারের কোন ধারণা সর্বতোভাবে পরিহার করিতে হইবে। সম্যক অনুশীলন দ্বারা পরিমার্জিত যে সাধারণ বুদ্ধিকে লোকে প্রতিভা আখ্যা দিয়া থাকে, তাহার উদ্ভব ব্রাহ্মণ বা কায়স্থের ন্যায় সামান্য দোকানদার অথবা কৃষকের মধ্যেও অনুরূপভাবে সম্ভবপর। সাহস কেবল ক্ষত্রিয়ের একচেটিয়া সম্পত্তি হইলে তান্তিয়া ভীল কোথায় থাকিত? তিনি বিশ্বাস করিতেন, বিধাতা সমগ্র ভারতবর্ষকেই গলাইবার পাত্রে নিক্ষেপ করিতে উদ্যত হইয়াছেন; তাহার ফলে কোন নব নব আকারের শক্তি ও মহত্ত্বের সৃষ্টি হইবে, তাহা পূর্ব হইতে বলা মানবের ক্ষমতাতীত।