নারীগণকে যোগ্যতার সহিত সমাজে উঠিয়া দাঁড়াইতে হইবে। অবনত হইলে চলিবে না। বিধবাশ্রম বা বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজসংক্রান্ত তাঁহার সকল পরিকল্পনায় বড় বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা জমির ব্যবস্থা থাকিত। যাহারা এই সকল স্থানে বাস করিবে, শারীরিক ব্যায়াম, উদ্যানসংরক্ষণ এবং পশুপালন প্রভৃতি তাহাদের নিত্য কর্তব্য বলিয়া গণ্য হওয়া প্রয়োজন। এই নূতন যাত্রাপথের পটভূমি ও প্রাণস্বরূপ হইবে ধর্ম ও উচ্চলক্ষ্যের প্রতি গভীর অনুরাগ-সংসার অপেক্ষা এই ধরনের বাসস্থান না আশ্রমের মধ্যেই যাহার সমধিক বিকাশ ঘটে। এই সকল বিদ্যালয়ের অধিবাসিনীগণ শীতঋতুর অবসানে তীর্থযাত্রায় বাহির হইবে এবং ছয়মাস হিমালয়ে অবস্থান করিয়া অধ্যয়নে রত থাকিবে। এইরূপে, এমন এক শ্রেণীর নারী সৃষ্টি হইবে, যাহারা ধর্মরাজ্যে হইবে ‘বাশিবাজুকদিগের’ সদৃশ(১); এবং তাহারাই নারীজাতির সকল সমস্যার সমাধান করিবে। কর্মক্ষেত্র ব্যতীত তাহাদের কোন গৃহ থাকিবে না, ধর্মই হইবে তাহাদের একমাত্র বন্ধন, এবং ভালবাসা থাকিবে কেবল গুরু, স্বদেশ ও জনগণের প্রতি। কতকটা এইরূপই ছিল তাহার কল্পনা। তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন, বিশেষ প্রয়োজন একদল শিক্ষয়িত্রীর—এবং এইভাবেই তাহাদের সংগ্রহ করিতে হইবে। শক্তি—শক্তিই একমাত্র গুণ, যাহার বিকাশ তিনি পুরুষ এবং নারী সকলের মধ্যে দেখিতে চাহিতেন। কিন্তু এই শক্তির বিন্যাস সম্পর্কে তাহার বিচার কত কঠোর ছিল! আত্মপ্রচার অথবা ভাবোচ্ছ্বাস, কোনটাই তাহার নিকট প্রশংসা লাভ করিত না। প্রাচীনকালের মৌন, মাধুর্য ও নিষ্ঠাপূর্ণ আদর্শ চরিত্রে তাহার মন এতদূর মুগ্ধ ছিল যে, বাহিরের কোন আড়ম্বর তাহাকে আকৃষ্ট করিতে পারিত না। সেই সঙ্গে বর্তমান যুগের যে চিন্তা ও জ্ঞান ভারতে বিশেষ উন্নতি সাধন করিয়াছে, তাহাতে পুরুষের ন্যায় নারীরও সম অধিকার। সত্যেকোন লিঙ্গভেদ নাই। আত্মা ও মনের উপর শরীরের বন্ধন আরও দৃঢ় করিয়া তুলিতে চাহে, এরূপ কোন সমাজ বা রাষ্ট্রনীতি তিনি আদৌ সহ্য করিতে পারিতেন না। যে নারী যত বড় হইবেন, তিনি ততই চরিত্র ও মনের নারীসুলভ দুর্বলতা অতিক্রম করিতে পারিবেন; এবং আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বহুসংখ্যক নারী এইরূপে উন্নতিলাভ করিয়া প্রশংসা অর্জন করিবেন।
স্বভাবতই তাহার আশা ছিল, বিধবাগণের মধ্য হইতেই প্রথম শিক্ষয়িত্রীদল সংগৃহীত হইবে এবং তাহারা পাশ্চাত্যদেশের মঠাধিকারিণীদের অনুরূপ হইবেন। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় এক্ষেত্রে তাঁহার নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছিল না। তাহার নিজের কথায় বলিতে গেলে তিনি শুধু বলিতেন, “জাগো! জাগো! সঙ্কল্পগুলি আপনা থেকেই বর্ধিত এবং কার্যে পরিণত হয়!” তথাপি কোন উপকরণ উপস্থিত হইলে—যেখান হইতেই উহা আসুক, তাঁহার সমাদর লাভ করিত। প্রত্যেক নারীর পক্ষে দৃঢ়, সবল চরিত্র, বুদ্ধিমতী এবং সত্যপথে পরিচালিত হইয়া নিজেকে উচ্চতম আদর্শের যন্ত্রস্বরূপ করিয়া তোেলা কেন সম্ভব হইবে না, এ বিষয়ে তিনি কোন কারণ খুঁজিয়া পাইতেন না। এমন কি, অসকার্য হেতু বিবেকের গ্লানিও অকপটতার দ্বারা দূর করিতে পারা যায়। নারীগণের উন্নতির সহিত সংশ্লিষ্ট আন্দোলন সম্পর্কে এক আধুনিক লেখক বলিয়াছেন, “সকল উচ্চ উদ্দেশ্য স্বাধীনভাবে অনুসরণ করা চাই।” স্বামীজী স্বাধীনতাকে ভয় পাইতেন না, এবং ভারতীয় নারীজাতির প্রতি তাহার কোন অবিশ্বাস ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার বিকাশ সম্বন্ধে তাহার যে কল্পনা ছিল, তাহা কোনপ্রকার আন্দোলন, হইচই বা প্রাচীন অনুষ্ঠানসমূহ চূর্ণ করিয়া ফেলা—এই সকলের দ্বারা সাধিত হইবার নহে। তাহার মতে যথার্থ স্বাধীনতা হইল পরোক্ষ,নীরব ও সাংগঠনিক। প্রথমে সমাজের প্রচলিত আদর্শগুলি নারীদের যথাযথভাবে গ্রহণ করিতে হইবে; তারপর যতই তাহারা অধিকতর গুণের অধিকারিণী হইবেন, জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আদেশ ও সুযোগগুলি যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইবেন। ঐ-সকল নির্দেশ পালন ও পূর্ণমাত্রায় সুযোগ গ্রহণের দ্বারা তাহারা পূর্বাপেক্ষা অধিকতর ভারতীয়ভাবাপন্ন হইয়া উঠিবেন এবং অবশেষে উন্নতির এরূপ উচ্চশিখরে আরোহণ করিবেন, অতীত ভারত যাহা কখনও স্বপ্নেও ভাবে নাই।
বোধ হয়, আমাদের জাতীয় জীবনধারার অবিচ্ছিন্নতা হৃদয়ঙ্গম করার মধ্যে স্বামীজীর স্বাধীন চিন্তার যেরূপ স্পষ্ট অভিব্যক্তি দেখা যায়, তেমন আর কিছুতেই নহে। কোন প্রথায় নূতন আকার তাহার নিকট সর্বদা প্রাচীন পবিত্র সংস্কারের দ্বারা পবিত্ৰীকৃত বলিয়া বোধ হইত। দেবী সরস্বতীর চিত্র অঙ্কন করাই তাহার ‘দেবীর পূজা’ বলিয়া মনে হইত; ভেষজ-বিজ্ঞান অধ্যয়নের অর্থ “রোগ ও অপরিচ্ছন্নতারূপ দানবদ্বয়ের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ভগবানের নিকট নতজানু হইয়া প্রার্থনা করা।” হিন্দুসমাজের মধ্যে নূতন ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে দুগ্ধ, মাখন প্রভৃতির সরবরাহ, পশুগণের জন্য চারণভূমির ব্যবস্থা ও তাহাদের পরিচর্যাবিধান ইত্যাদি ভাব যে পূর্ব হইতেই যথেষ্ট পরিমাণে বর্তমান ছিল, প্রাচীনকালে ভক্তিভরে গোসেবা তাহারই পরিচয় প্রদান করে। তাহার মতে, বুদ্ধিবৃত্তির চরম উৎকর্ষসাধনের অনুশীলন আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণাদির শক্তিলাভের পক্ষে অপরিহার্য; অধানই তপস্যা, এবং হিন্দুদের ধ্যানপরায়ণতা বৈজ্ঞানিক অন্তদৃষ্টিলাভের উপায়। সকল কার্যই একপ্রকার ত্যাগ। গৃহ ও পরিবারবর্গের প্রতি ভালবাসাও সর্বদা মহত্তর ও বিশ্বজনীন প্রীতিতে পরিণত হইতে পারে।