অবশ্য, বিভিন্ন দলের সংগঠনকালেই সমাজের শক্তির সর্বাধিক বিকাশ ঘটে, এবং স্বামীজী এই বিষয়টির উপর বিশেষ চিন্তা করিতেন যে, একবার কোন নির্দিষ্ট গঠন প্রাপ্ত হইবার পর উহার মধ্যে আর প্রাণসঞ্চার অথবা অনুপ্রেরণা দান করিবার ক্ষমতা থাকে না। তাহার নিকট ‘নির্দিষ্ট আকার প্রাপ্ত’ ও ‘মৃত’ সমানার্থক শব্দ। কোন সমাজ চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট আকারে সংগঠিত হইয়া গেলে উহার অবস্থা সেই বৃক্ষের ন্যায় হইয়া যায়, যাহার আর বৃদ্ধির সম্ভাবনা নাই। উহার নিকট আর কিছু প্রত্যাশা করার অর্থ মিথ্যা ভাবুকতা, এবং স্বামীজীর দৃষ্টিতে ভাবুকতা হইল স্বার্থপরতা, ‘ইন্দ্রিয়ের অসংযত উচ্ছ্বাসমাত্র’।
জাতিভেদ-প্রথা সম্পর্কে স্বামীজী সর্বদাই আলোচনা করিতেন। কদাচিৎ উহার বিরুদ্ধে সমালোচনা করিতেন, বরং সর্বদাই উহার পশ্চাতে অবস্থিত কারণ অনুসন্ধান করিতেন। জাতিভেদ মানবজীবনের এক অনিবার্য ব্যাপার বলিয়া মনে করায়, উহা কেবল হিন্দুধর্মেরই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য বলিয়া তিনি ভাবিতে পারিতেন না। জনৈক ইংরেজ যে একদা মহীশুরে গোবধ করিয়াছিলেন, সমবেত ভদ্রলোকদের সামনে তাহা স্বীকার করিতে ইতস্ততঃ করিতেছেন দেখিয়া স্বামীজী বলিয়া ওঠেন, “স্বজাতির মতামতই কোন ব্যক্তিকে ধর্মপথে রাখবার শেষ ও শ্রেষ্ঠতম উপায়।” অতঃপর দুই-চারি কথায় তিনি দুই প্রকার আদর্শের মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তাহার বর্ণনা দেন—একটি আদর্শ শিষ্ট ও দুষ্টের মধ্যে অথবা ধার্মিক ও নাস্তিকের মধ্যে প্রভেদ নির্দেশ করে, অপরটি এক সূক্ষ্মতর, সংগঠনমূলক নৈতিক আদর্শ, যাহা আমাদের সমকক্ষ বলিয়া মনে করি, এরূপ অল্প সংখ্যক ব্যক্তির শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিবার প্রচেষ্টা জাগাইয়া দেয়।
কিন্তু এই প্রকার মন্তব্যগুলি পক্ষপাতিত্বের পরিচায়ক নয়। সন্ন্যাসী শুধু সাক্ষীর ন্যায় জীবনকে দেখিয়া যাইবেন, কোন পক্ষ অবলম্বন করিবেন না। তাহার নিকট এমন বহু প্রস্তাব আসিয়াছিল, যাহা গ্রহণ করিলে তিনি যে কোন একটি সম্প্রদায়ের নেতারূপে পরিগণিত হইতেন, কিন্তু ঐ সকল তিনি অগ্রাহ্য করেন। নারীজাতি ও জনগণকে কেবল শিক্ষা দেওয়া হউক; তাহাদের ভবিষ্যৎসংক্রান্ত সকল প্রশ্নের মীমাংসা করিতে তাহারা নিজেরাই সমর্থ হইবে। স্বাধীনতা সম্পর্কে ইহাই ছিল তাহার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইহাই তিনি আজীবন প্রচার করিয়াছেন। শিক্ষা কি ধরনের হইবে সে সম্বন্ধে নিজ অভিজ্ঞতা হইতে তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, এ পর্যন্ত ঐ সম্পর্কে কিছুই নির্দিষ্ট হয় নাই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও অসতী বিধবার পাপ-আচরণ বলিয়া যাহা অভিহিত, তাহার প্রতি তাঁহার দারুণ ঘৃণা ছিল। তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করিতেন ও বলিতেন, “আর যা হয় হোক, কিন্তু এটি যেন কখনো না হয়।” তাহার নিকট বৈধব্যের শ্বেতবাস ছিল যাহা কিছু পবিত্র ও সত্য, তাহারই প্রতীকস্বরূপ। সুতরাং এই সকল ভাবের সহিত সম্পর্কশূন্য কোন শিক্ষাপ্রণালীর কথা স্বভাবতই তিনি চিন্তা করিতে পারিতেন না। চঞ্চল, বিলাসপরায়ণ ও জাতীয়তাভ্রষ্ট কোন ব্যক্তি, বাহিরের শত পারিপাট্য সত্ত্বেও, তাহার মতে শিক্ষিত নহে, বরং অধঃপতিত। পক্ষান্তরে, কোন আধুনিকভাবাপন্ন নারীর মধ্যে যদি সেই প্রাচীনকালের ন্যায় একান্ত নির্ভরতা ও পরম ভক্তির সহিত স্বামীর প্রতি আনুগত্য এবং শ্বশুরগৃহের পরিজনদের প্রতি পুরাকালের নিষ্ঠা দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে তাহার দৃষ্টিতে তিনিই হইতেন ‘আদর্শ হিন্দুপত্নী। প্রকৃত সন্ন্যাসের ন্যায় যথার্থ নারীজীবনও কেবল লোক-দেখানো ব্যাপার নয়। আর প্রকৃত নারীজনোচিত গুণগুলির প্রচার ও বিকাশে সহায়তা ব্যতীত কোন স্ত্রীশিক্ষাই যথার্থ স্ত্রীশিক্ষা বলিয়া গণ্য হইতে পারে না।
ভাবী আদর্শ নারীর লক্ষণগুলি যদি দৈবাৎ মিলিয়া যায়, তিনি সর্বদা তাহার সন্ধানে থাকিতেন। কিছু পরিমাণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ অবশ্যম্ভাবী, সেই সঙ্গে অধিকতর বয়সে বিবাহ এবং স্বামী নির্বাচনে কতকটা ব্যক্তিগত মতামত—এসবও আসিবেই। সম্ভবতঃ অন্য উপায় অপেক্ষা ইহা দ্বারাই বাল্যবৈধব্যজনিত সমস্যাসমূহের প্রকৃষ্ট সমাধান হইবে। কিন্তু সেই সঙ্গে ইহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে, সেই যুগে অধিক বয়সে বিবাহের পরিণামস্বরূপ কতকগুলি দোষ পরিহার করিবার উদ্দেশ্যেই সমাজ কর্তৃক বিশেষ বিবেচনাপূর্বক বাল্যবিবাহ প্রথার সৃষ্টি হয়।
ভবিষ্যতের হিন্দুনারীকে তিনি সম্পূর্ণভাবে প্রাচীনকালের ধ্যানশক্তিবর্জিত বলিয়া চিন্তা করিতে পারিতেন না। নারীগণের আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু প্রাচীন আধ্যাত্মিকতা বা ধর্ম বিসর্জন দিয়া নহে। তিনি স্পষ্টই বুঝিয়াছিলেন, যে শিক্ষাপদ্ধতি সমগ্র সমাজে প্রত্যক্ষ পরিবর্তন সাধনের জন্য সর্বাপেক্ষা কম প্রভাব প্রয়োগ করিবে, তাহাই আদর্শ শিক্ষা। যে শিক্ষা কালে প্রত্যেক নারীকে একাধারে ভারতের অতীত যুগের নারীজাতির শ্রেষ্ঠ গুণগুলি বা মহত্ত্ব বিকাশে সহায়তা করিতে সমর্থ, তাহাই আদর্শ শিক্ষা।
অতীতকালের প্রত্যেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ পৃথকভাবে নিজ কার্য সাধন করিয়াছে। রাজপুত ইতিহাস জাতীয় আদর্শ নারীজীবনের বীরত্ব ও সাহসে পরিপূর্ণ। কিন্তু ঐ জ্বলন্ত ও দ্রবীভূত ধাতুকে এখন নূতন ছাঁচে ঢালিতে হইবে। অতীত ভারতে যত মহীয়সী নারী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, রানী অহল্যাবাঈ তাহাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়া। দেশের সর্বত্র তাহার জনহিতকর কীর্তি-দর্শনে একজন ভারতীয় সাধুর পক্ষে ঐরূপ চিন্তাই স্বাভাবিক। তথাপি ভাবী নারীগণের মহত্ত্ব তাহার প্রতিরূপ মাত্র হইবে না; উহাকে অতিক্রম করিয়া যাইবে। আগামী যুগের নারীর মধ্যে বীরোচিত দৃঢ়সঙ্কল্পের সহিত জননীসুলভ হৃদয়ের সমাবেশ ঘটিবে। যে বৈদিক অগ্নিহোত্রাদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক সাবিত্রীর আবির্ভাব, উহাই আদর্শ অবস্থা, কিন্তু ভবিষ্যৎ নারীর মধ্যে মলয়-সমীরের কোমলতা এবং মাধুর্যেরও বিকাশ ঘটিবে।