এই ঘটনাদ্বয় স্বামী বিবেকানন্দের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে; সম্ভবতঃ স্বামীজী নিজে সে প্রভাবের সম্যক পরিচয় পান নাই। তাঁহার গুরুদেবের শিষ্যগণ যে ধর্ম-আন্দোলন সংগঠন করেন, এক হিসাবে নিম্নশ্রেণীর এক নারীই তাহার মূল কারণস্বরূপ। মানবিক দৃষ্টিতে দেখিলে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির না হইলে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণকে পাইতাম না, শ্রীরামকৃষ্ণ না থাকিলে স্বামী বিবেকানন্দও আসিতেন না, এবং স্বামী বিবেকানন্দ ব্যতীত পাশ্চাত্যদেশে কোন প্রচারকার্যও হইত না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের ঠিক পূর্বে কলিকাতার কয়েক মাইল উত্তরে গঙ্গাতীরে এক কালীবাড়ি নির্মাণের উপরই সমগ্র ব্যাপারটি নির্ভর করিয়াছে। তাহাও আবার নিম্নজাতির এক ধনবতী নারীর ভক্তির ফল। স্বামীজী স্বয়ং আমাদের মনে করাইয়া দিতে ভোলেন নাই যে, ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য-সংরক্ষণে দৃঢ়বদ্ধ হিন্দুরাজগণ কর্তৃক এদেশ সম্পূর্ণরূপে শাসিত হইলে ঐরূপ ঘটা কদাপি সম্ভব হইত না। এই ঘটনা হইতে তিনি ভারতে সার্বভৌম শাসকবৃন্দের জাতিভেদের প্রতি সবিশেষ মনোযোগ অর্পণ না করার গুরুত্ব অনুমান করেন।
রানী রাসমণি তাহার সময়ের একজন বীরপ্রকৃতির নারী ছিলেন। কিরূপে তিনি কলিকাতার জেলেদের অন্যায় করভার হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন, এখনও লোকমুখে সে গল্প শুনিতে পাওয়া যায়। সরকার যে বিপুল অর্থ দাবি করেন, তাহা দিবার জন্য তিনি প্রথমে স্বামীকে সম্মত করান। অতঃপর নদীর উপর দিযা বিদেশীয় জাহাজ গমনাগমন একেবারে বন্ধ করিয়া দিবার জন্য দৃঢ় মনোভাব অবলম্বন করেন। সুসমৃদ্ধ গড়ের মাঠ বা ময়দানে তাহার অধিকৃত রাস্তা দিয়া তাহার পরিজনবর্গ কেন দেবপ্রতিমা লইয়া যাইতে পারিবেন না, তাহা লইয়া তিনি বেশ ভালমতো যুদ্ধ বাধাইয়া দেন। তাহার বক্তব্য ছিল, ইংরেজরা যদি ভারতবাসীর ধর্ম পছন্দ না করেন, তাহা হইলে যে পথে প্রতিমাসহ শোভাযাত্রা বাহির হয়, তাহার আপত্তিকর অংশের দক্ষিণে ও বামে প্রাচীর তুলিয়া দিলেই হয়–উহাতে বিশেষ হাঙ্গামা কি? সেইরূপই করা হইল। ফল হইল এই যে, কলিকাতার ‘রতন রো’ নামক চমৎকার রাজপথটি মাঝখানে বন্ধ হইয়া গেল। বৈধব্যদশা ঘটিবার কিছুদিন পরেই ব্যাঙ্কারদের নিকট সঞ্চিত বিপুল অর্থ স্বহস্তে উঠাইয়া লইবার জন্য তাহাকে সমগ্র বুদ্ধি-কৌশল প্রয়োগ করিতে হয়। ঐ অর্থ তিনি নিজে খাটাইবার সঙ্কল্প করেন। কার্যটি কঠিন হইলেও অসীম বুদ্ধি ও দক্ষতাসহকারে তিনি উহা সম্পাদন করেন এবং তখন হইতে সমস্ত কার্য নিজেই পরিচালনা করিতেন। বহুদিন পরে এক বড় মকদ্দমার কৌসুলীর মাধ্যমে তাহার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বপূর্ণ উত্তর প্রদান ও প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করার কাহিনী আজ পর্যন্ত কলিকাতার প্রতি হিন্দুপরিবারে চলিয়া আসিতেছে।
রানী রাসমণির জামাতা মথুরবাবুর নাম শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম জীবনের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। যখন আশেপাশের সকল লোক সেই মহাসাধককে ধর্মোন্মাদ বলিয়া স্থির করে, তখন তিনিই তাহাকে রক্ষা করেন। কোনরূপ কাজকর্ম না করা সত্ত্বেও বরাবর শ্রীরামকৃষ্ণ বৃত্তি ও বাসস্থানের সুবিধা পাইবেন—এ ব্যবস্থা তিনিই করিয়া দেন। এই সকল বিষয়ে মথুরবাবু তাহার শশূঠাকুরানীর প্রতিনিধিরূপে কার্য করিতেন। প্রথমাবধি রানী রাসমণি শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মবিষয়ে অদ্ভুত প্রতিভা উপলব্ধি করিতে সক্ষম হন এবং আজীবন নিষ্ঠার সহিত তাহার সেই প্রথম ধারণা অব্যাহত রাখেন।
তথাপি শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কামারপুকুরের ব্রাহ্মণযুবকরূপে দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আগমন করেন, তখন তিনি এত আচারনিষ্ঠ ছিলেন যে, এক নিম্নশ্রেণীর নারীকর্তৃক মন্দির নির্মাণ এবং ঐ উদ্দেশ্যে সম্পত্তি দান তাহার অত্যন্ত বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল। তিনি ছিলেন প্রধান পুরোহিতের কনিষ্ঠভ্রাতা এবং সেজন্য প্রতিষ্ঠাদিবসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাহাকে পূজানুষ্ঠান কার্যে সহায়তা করিতে হয়। কিন্তু কিছুতেই তিনি প্রসাদ গ্রহণে সম্মত হন নাই। শুনা যায়, সব শেষ হইয়া গেলে এবং সমাগত লোকজন চলিয়া গেলে গভীর রাত্রে তিনি বাজার হইতে একমুঠা ছোলাভাজা কিনিয়া আনেন এবং উহা খাইয়া সারাদিন উপবাসের পর ক্ষুধা নিবৃত্ত করেন।
পরবর্তী কালে কালীবাড়িতে তিনি যে পদ অধিকার করেন, এই ঘটনাটি নিশ্চিত তাহার তাৎপর্য গভীরতর করিয়া তোলে। ভ্রমবশতঃ তিনি কদাপি কৈবর্তবংশীয়া রানীর সম্মানিত অতিথি বা তাহার দ্বারা প্রতিপালিত হন নাই। আমাদের বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, যখন তিনি জানিতে পারেন, জগতে তাঁহাকে কোন কার্য সাধন করিতে হইবে, তখন ইহাও হৃদয়ঙ্গম করেন যে, বাল্যকালে পল্লীগ্রামের কঠোর আচারনিষ্ঠ অভ্যস্ত জীবন ঐ কার্যে সহায়ক না হইয়া বরং প্রতিকূলই হইবে। আমরা ইহাও বলিতে পারি, তাহার সমগ্র জীবন এই কথাই ঘোষণা করিতেছে যে, সামাজিক জীবনে কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে মানুষ যে পদেই অধিষ্ঠিত থাকুক, ধর্মজীবনে সকলের সমান অধিকারে তাহার বিশ্বাস ছিল।
আমাদের গুরুদেব অন্ততঃ মনে করিতেন, তিনি যে সঙ্ঘভুক্ত, তাহার ব্রত হইল নারীজাতি ও নিম্নশ্রেণীর লোকদিগের উন্নতিসাধন। খেতড়ির রাজাকে তাহার বার্তা পাঠাইবার জন্য আমেরিকায় যখন তিনি ফনোগ্রাফের সামনে কয়েকটি কথা বলেন, তখন সহজ প্রেরণাবশতঃ ঐ বিষয়টি তাহার মনে ওঠে। বিদেশে একাকী যখনই তিনি নিজেকে মৃত্যুর অধিকতর নিকটবর্তী জ্ঞান করিতেন, ঐ চিন্তাই তাহার হৃদয় অধিকার করিত এবং নিকটে উপবিষ্ট শিষ্যকে বলিতেন, “কখনো ভুলো না, নারীজাতি ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের উন্নতিসাধনই আমাদের মূলমন্ত্র।”