স্বামীজী জাগিয়া উঠিলেন; তাঁহার বোধ হইল, উহা সাধারণ স্বপ্ন নহে। খোলা বাতাসে বেড়াইবার উদ্দেশ্যে তিনি কোনরকমে ডেকের উপর আসিলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, জাহাজের একজন কর্মচারী তাহার নির্দিষ্ট কর্ম সমাপনান্তে নিজ কামরায় ফিরিয়া যাইতেছেন। স্বামীজী জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কটা বেজেছে?
উত্তর হইল, ‘মধ্যরাত্রি।
“আমরা এখন কোথায়?”
“ক্রীটের ঠিক পঞ্চাশ মাইল দূরে।”
এই অপ্রত্যাশিত ঐক্যদর্শনে স্বামীজী বিস্মিত বোধ করিলেন, এবং স্বপ্নটির সত্যতা সম্বন্ধে তাহার প্রত্যয় দৃঢ় হইল। এখন তাহার বোধ হইল, ঐ অভিজ্ঞতা এমন কতকগুলি ইঙ্গিত বহন করিতেছে, যাহা উহার সাহায্য ব্যতীত তাহার নিকট চিরদিন অসম্বদ্ধ ও অর্থহীন বলিয়া প্রতীত হইত। পরে তিনি স্বীকার করেন, ইতিপূর্বে খ্রীস্টের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করিবার কথা তাহার মনে উদয় হয় নাই; এবং এই ঘটনার পরে ঐ বিষয়ে তিনি আর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারেন যে, কেবল সেন্ট পল সম্পর্কেই আমরা নিশ্চিত হইতে পারি। খ্রীস্টের দ্বাদশ শিষ্যের কার্যাবলী’ (Act of the Apostles) নামক গ্রন্থ ‘গসপেল চতুষ্টয় অপেক্ষা প্রাচীনতর কেন, তাহার অর্থও তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন। তিনি আরও অনুমান করেন, সম্ভবতঃ খ্রস্টের উপদেশাবলী র্যাবাই হিলেল(Rabbi Hillel)(৬) হইতে উদ্ভূত, এবং ন্যাজারীন নামক প্রাচীন সম্প্রদায় ও সুদূর অতীতের গর্ভ হইতে প্রতিধ্বনিত তাহাদের সুন্দর উক্তিসমূহই খ্রস্টের নাম ও জীবন প্রদান করিয়াছে।(৭)
কিন্তু এই দর্শন তাহার নিজের মনের উপর অনস্বীকার্য প্রভাব বিস্তার করিলেও, অপরের নিকট উহা প্রমাণস্বরূপ উপস্থিত করিতে যাওয়া তাঁহার বাতুলতা বলিয়া মনে হইত। তিনি মনে করিতেন, এইরূপ অনুভূতির কোন ফলাফল আছে স্বীকার করিয়া লইলেও, উহা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত—অর্থাৎ যিনি ঐ প্রকার অনুভব করিয়াছেন, তাহারই কাজে উহা লাগিবে। ঐ স্বপ্নদর্শন প্রভাবে ন্যাজারেথবাসী ঈশার ঐতিহাসিক চরিত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে স্বামীজীর অবিশ্বাসের সম্ভাবনা থাকিলেও,ক্রীট দ্বীপ সম্ভবতঃ খ্রীস্টধর্মের জন্মভূমি একথা তিনি কখনও উল্লেখ করেন নাই। লৌকিক পণ্ডিতগণের নিকট উহা অনুমানমাত্র, যাহার সত্যাসত্য তাহারাই নির্ধারণ করিতে পারিবেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় ভারতীয় ও মিশরীয় ভাবের মিলনের সর্বজনস্বীকৃত ঐতিহাসিক ঘটনা যাহা কেবল ভৌগোলিক ব্যাপার মাত্র, তিনি তাহারই উল্লেখ করিতেন। আর যৌক্তিকতার দিক দিয়া ঐ সম্পর্কে সন্দেহ থাকিলেও মেরীতনয়ের প্রতি তাহার জ্বলন্ত ভক্তির কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। হিন্দুদের মতে আদর্শ হিসাবে কোন আদর্শের সর্বাঙ্গসম্পূর্ণতাই আসল জিনিস, দেশকালের সহিত উহার সম্বন্ধ কতদূর সত্য, তাহা দেখিবার প্রয়োজন নাই। সুতরাং ভক্তিবশতঃ পুত্রক্রোড়ে খ্রীস্টমার (সিষ্টিন ম্যাডোনা) কোন ছবিকে আশীর্বাদ করিতে অস্বীকারপূর্বক উহার পরিবর্তে ঐ দিব্যশিশুর পাদস্পর্শ করা স্বামীজীর পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক। সেইরূপ জনৈকা মহিলার প্রশ্নের যে উত্তর তিনি দেন, তাহাও খুবই স্বাভাবিক হইয়াছিল—”যদি আমি ন্যাজারেথবাসী ঈশার সময়ে প্যালেস্টাইনে বাস করতাম, তাহলে চোখের জলে নয়, হৃদয়ের শশাণিত দিয়ে আমি তার পা-দুখানি ধুয়ে দিতাম।” অধিকন্তু, এ বিষয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের স্পষ্ট সম্মতিও লাভ করেন। বাল্যকালে তিনি ব্যগ্রভাবে অনুরূপ একটি প্রশ্ন সম্পর্কে তাহার মতামত জানিতে চাহেন। উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, “তোমার কি একথা মনে হয় না যে, যারা এই প্রকার সব জিনিস সৃষ্টি করতে পেরেছেন, তারা অপরের উপাসনার জন্য যেসব আদর্শ প্রচার করতেন, নিজেরাই তাদের জীবন্ত মূর্তি ছিলেন?”
————
১ খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে পোপ প্রথম গ্রেগবি রোমান ক্যাথলিক উপাসনার অঙ্গস্বরূপ উক্ত-সুরের প্রবর্তন করেন। ঐ সুব সাদাসিধা অথচ গম্ভীর, এবং উহাতে আরোহ-অববোহ অধিক নাই।–অনুঃ
২ স্বামী সারদানন্দ বলেন, স্বামীজীর ঐ দর্শন শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনের প্রায় দুই বৎসর পরে, সম্ভবতঃ ১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ঘটে। যে মন্ত্রটি তিনি শুনিয়াছিলেন, তাহা গায়ত্রী দেবীর আবাহনঃ
আয়াহি বরদে দেবি এ্যক্ষরে ব্রহ্মবাদিনি।
গায়ত্রি ছন্দসাং মাতঃ ব্রহ্মযোনি নমোহস্তুতে।।
৩ ফ্লেভিয়াস্ এনিসিস্ জাস্টিনিয়ানা(৪৮২-৫৬৫) ছিলেন নোম সাম্রাজ্যের অধিপতি। তিনি তাঁহার সময়ে প্রচলিত নীতিসমূহ “Corpus Juris Civilis” নামে সংহত করেন এবং সেজন্যই জগতে চিরস্মরণীয় হইয়া আছেন।–অনুঃ
৪ স্টেশিয়াস-প্রণীত খীবসের ইতিবৃত্তিমূলক ল্যাটিন কাব্যখ্রস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত। থী প্রাচীন গ্রীসের এক অংশের সমৃদ্ধ রাজধানী ছিল। সিংহাসন-প্রার্থী ভ্রায়ের পরস্পর যুদ্ধই উহার আখ্যানবস্তু।-অনুঃ
৫ আমার নিজের বিশ্বাস, দ্বিতীয় শব্দটি ‘Essene’, কিন্তু দুঃখের বিষয় উহার সংস্কৃত ধাতুপ্রত্যয় আমার স্মরণ নাই।
৬ ইহুদী ধর্মশাস্ত্রের প্রধান পণ্ডিতবর্গের অন্যতম। খ্রীস্টপূর্ব ৬০ অব্দে ইনি জন্মগ্রহণ কবেন।–অনুঃ
৭ অথবা হয়তো তিনি ভাবিয়াছিলেন, ঈশার ‘সুন্দর উক্তিগুলি’ প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধেরই বাণী এবং ‘গসপেল’গুলিতে যে কাহিনীর উল্লেখ আছে, তাহা শুধু ঈশ্বর দর্শনের আর একটি পথ প্রদর্শন কবে।
২০. নারীজাতি ও জনসাধারণ
দক্ষিণেশ্বর মন্দির জাতিতে কৈবর্ত ধনাঢ্য রানী রাসমণি কর্তৃক নির্মিত হয়, এবং ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের অন্যতম পূজারীরূপে সেখানে বাস করিতে আরম্ভ করেন।